Tuesday, 5 January 2016

গ্যদ গীতা.........,.......পরিবেশক তাপস হালদার

প্রথম অধ্যায়ঃ অর্জুন-বিষাদযোগ ধৃতরাষ্ট্র বললেন -হে সঞ্জয়, ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে আমার পুত্রগণ এবং পাণ্ডুর পুত্রগণ যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়ে কী করলেন?১সঞ্জয় বললেন -তখন রাজা দুর্যোধন পাণ্ডব সৈন্যদেরকে ব্যূহাকারে সজ্জিত দেখে দ্রোণাচার্যের নিকট গিয়ে বললেন।২গুরুদেব, আপনার ধীমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র কর্তৃক ব্যূহবদ্ধ পাণ্ডবদের এই বিশাল সৈন্য দেখুন।৩এই সৈন্যদলে ভীমার্জুনের সমান বীরগণ আছেন। সাত্যকি, বিরাট ও বীর দ্রুপদ আছেন।৪এই সৈন্যদলে ধৃষ্টকেতু চেকিতান, বীর কাশীরাজ কুন্তিভোজপুরুজিত্, নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য আছেন।৫আর আছেন -পরাক্রমশালী যুধামন্য, বীর উত্তমৌজা, সুভদ্রাপুত্র অভিমন্যু ও দ্রৌপদি পুত্রগণ। এরা সকলেই বীর।৬হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আমার সৈন্যদলের প্রধান সেনানায়কদের নাম বলছি শুনুন।৭এখানে আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, যুদ্ধজয়ী কৃপা, অশ্বত্থমা, বিকর্ণ, সোমদত্ত পুত্র ও জয়দ্রথ আজেন।৮আরো অনেক বীর আছেন। তাঁরা সকলেই অস্ত্রধারী বীর ও যুদ্ধে পারদর্শী। সকলেই আমার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত।৯ভীষ্মকর্তৃক রক্ষিত আমাদের সৈন্য অসংখ্য। আর ভীমকর্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবদের সৈন্য অতি অল্প।১০সঞ্জয় বললেন -অর্জুনের কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ উভয় সেনার মধ্যে রথ স্থাপিত করে অর্জুনকে বললেন।২৪শ্রীকৃষ্ণ বললেন -হে অর্জুন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, প্রভৃতিকুরুপক্ষীয় যোদ্ধাগণকে চেয়ে দেখ।২৫অর্জুন গুরুজন, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর এবং বন্ধুগণকে দেখলেন।২৬তাঁদের সকলকে বিপক্ষে দেখে দয়াযুক্ত হয়ে দুঃখিত মনে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন।২৭অর্জুন বললেন -হে কৃষ্ণ আত্মীয়গণকে বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য উপস্থিত দেখে আমার মুখ শুকিয়ে গেছে ও শরীর বিকল হয়েছে।২৮আমার শরীর কাঁপছে ও রোমহর্ষ হচ্ছে। আমার হাত হতে ধনু খসে পড়ছে, গা জ্বলছে।২৯হে কৃষ্ণ, আমার মাথা ঘুরছে। আমি সব বিপরীত লক্ষণ দেখছি।৩০আত্মীয়গণকে মেরে মঙ্গল হবে না। হে কৃষ্ণ, আমি জয় চাই না এবং রাজ্য, সুখ, ধনও চাই না।৩১হে কৃষ্ণ, যাদের জন্য রাজ্য ভোগ ও প্রাণ, সেই আত্মীয়গণকেমেরে কী লাভ।৩২গুরু, পিতামহ ভীষ্ম ও আত্মীয়গণ সকলে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে উপস্থিত হয়েছেন।৩৩মাতুল, শ্বশুর, শ্যালকাদি সকলে প্রাণ দিতে এসেছেন। তাঁরা আমাদের মারুক আপত্তি নাই, কিন্তু আমি তাঁদেরকে মারতে পারব না।৩৪তাঁদেরকে বধ করে ত্রিভূবন লাভ করলেও কোনো ফল হবে না।৩৫কৌরবগণকে বধ করে বিন্দুমাত্র শান্তি হবে না। আততায়ী হলেও তাঁরা আপনজন জ্ঞাতি। হে কৃষ্ণ, জ্ঞাতিগণকে বধ করে আমি সুখি হতে পারব কি?৩৬লোভের বশে তাঁরা হিতাহিত চিন্তা করতে পারছে না। আপনজনের সাথে বিবাদে কুলক্ষয় হয়। কুলক্ষয় হলে ভীষণ পাপ হয়।৩৭হে কৃষ্ণ, আমরাও জানি যে, এই যুদ্ধে বংশনাসেরই সম্ভাবনা। তবে এই যুদ্ধে বিরত হব না কেন?৩৮বংশ নষ্ট হলে কুলধর্ম নষ্ট হয়। কুলধর্ম নষ্ট হলে অধর্ম ঘটে।৩৯অধর্ম ঘটলে কুলনারীগণ চরিত্রহীন হয়। কুলনারীগণ চরিত্রহীন হলে বর্ণ সঙ্কর জন্মে।৪০বর্ণসঙ্করের জন্য কুলনাশকারীরা ও কুল নরকে যায়। জল পিণ্ডের অভাবে পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হন।৪১বর্ণসঙ্কর জন্মিলে কুলধর্ম ও জাতিধর্ম নষ্ট হয়।৪২কুলধর্ম নষ্ট হলে নরকে বাস হয়। হে কৃষ্ণ, এটি তো শাস্ত্রের বচন।৪৩রাজ্য ও সুখভোগের লোভে আমরা মহাপাপ করতে বসেছি।৪৪হে কৃষ্ণ, কৌরবগণ যদি অস্ত্রহীন আমাকে বধও করে তাও মঙ্গলের কারণ হবে।৪৫সঞ্জয় বললেন- শোকাকুল অর্জুন এই কথা বলে ধনুর্বাণ ত্যাগকরে রথের উপর বসে পড়লেন।৪৬ * আর্জুন বিষাদযোগ সমাপ্ত * দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ সাংখ্যযোগ পৃষ্ঠা-১ সঞ্জয় বললেন- অর্জুনকে শোকাকুল, দুঃখিত ও অশ্রুসিক্ত দেখে শ্রীকৃষ্ণ বললেন।১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, এই বিপদের সময় তোমার এরূপ মোহের উদ্ভব হল কেন? এ তো আর্যজনোচিত নয়। বরং অতিশয় নিন্দনীয়।২হে অর্জুন, মোহ ত্যাগ কর। দুর্বলতা দূর কর। এরূপ দুর্বলতা তোমার সাজে না।৩অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, যুদ্ধক্ষেত্রে পূজ্যপাদ ভীষ্ম ও দ্রোণের প্রতি আমি কীরূপে বাণ নিক্ষেপ করব?৪আমি গুরুজনদেরকে হত্যা করব না। তাঁদের রক্তে রঞ্জিত রাজ্যও ভোগ করব না। বরং আমি ভিক্ষান্ন খেয়ে জীবন ধারণ করব।৫অবাধ্য আত্মীয়স্বজনগণ যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন। জয় এবং পরাজয়- এদের কোনটি আমার পক্ষে মঙ্গলজনক তা বলুন।৬অজ্ঞান আমি কুল নাশের ভয়ে ভীত। আমি তোমার শিষ্য ও শরণাপন্ন। আমাকে বিহিত উপদেশ দাও।৭নিষ্ককণ্টক রাজ্য কিংবা স্বর্গের রাজত্ব পেলেও আমার শান্তির পরিবর্তে অশান্তিই ঘটবে।৮সঞ্জয় বললেন- শ্রীকৃষ্ণকে অর্জুন “আমি যুদ্ধ করব না” এই কথা বলে চুপ করে রইলেন।৯তখন শ্রীকৃষ্ণ বিষণ্ণ অর্জুনকে প্রসন্নবদনে বললেন।১০শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, যাদের জন্য শোক করা উচিত নয়তুমি তাদের জন্যই শোক করছ; অথচ জ্ঞানীর মত কথা বলছ। জ্ঞানী ব্যক্তি মৃত বা জীবিতের জন্য কখনো শোক করেন না।১১এই রাজগণ, তুমি ও আমি- আমরা সকলেই পূর্বে ছিলাম, এখনো আছি, পরেও থাকব।১২মানুষের দেহে শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য যেভাবে আসে মৃত্যুওসেভাবে আসে। জ্ঞানী ব্যক্তি তাতে শোক করেন না।১৩শীত, উষ্ণ, সুখ, দুঃখ, প্রভৃতি বিষয়জনিত ও অনিত্য। এরা আসে যায়। হে অর্জুন, তুমি এই সব সহ্য কর।১৪যে ব্যক্তি এই সকলে বিচলিত হন না, তিনি মোক্ষ লাভ করতে পারেন।১৫অসত্ বস্তু স্থায়ী হয় না। স্থায়ী বস্তু বিনষ্ট হয় না। জ্ঞানী ব্যক্তি এই তত্ত্ব অবগত থাকেন।১৬আত্মা অবিনাশী ও সর্বব্যাপী। কেউ তা বিনাশ করতে পারে না।১৭দেহ অনিত্য কিন্তু আত্মা নিত্য। হে অর্জুন, এটি স্মরণ করে যুদ্ধ কর।১৮যে ব্যক্তি বলে যে, আত্মহত্যা করেন কিংবা হত হন, আত্মা যে সর্বব্যাপী তা সে জানে না।১৯আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, ক্ষয় নাই, বৃদ্ধি নেই। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা নষ্ট হয় না।২০যে ব্যক্তি আত্মাকে অবিনাশী বলে জানে, সে ব্যক্তি কাউকেও হত্যা করতে বা হত্যা করাতে পারে না।২১মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মাও সেরকম জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর গ্রহণ করে।২২অত্মাকে অস্ত্র দিয়ে কাটা যায় না, আগুনে পোড়ান যায় না, জলে ভিজান যায় না, বাতাসে শুকান যায় না।২৩আত্মা কখনও ছিন্ন, দগ্ধ, সিক্ত ও শুষ্ক হয় না। অত্মা সর্বব্যাপী, স্থির, অচল ও সনাতন।২৪অতএব অব্যক্ত, অচিন্ত্য, নিত্য ও নির্বিকার আত্মার জন্যশোক করা তোমার উচিত নয়।২৫আর তুমি যদি মনে কর যে, আত্মা দেহের সাথে জন্মে ও দেহের সাথে বিনষ্ট হয়, তবু আত্মার জন্য শোক করা তোমার উচিত নয়।২৬জন্মের পর মৃত্যু, মৃত্যুর পর জন্ম- এটি নিশ্চিত। এটি জেনেও তোমার শোক করা উচিত নয়।২৭পূর্বজন্ম ও পরজন্মের কথা বলা যায় না। এই জন্মের অবস্থাই কেবল বলা যায়।২৮আত্মা কীরূপ তা বুঝা সহজ নয়। সকলের নিকটই আত্মা আশ্চর্যকিছু।২৯আত্মা প্রতি শরীরেই অবস্থিত আছেন। তিনি অবাধ্য। অতএব কারো জন্যেই শোক করা উচিত নয়।৩০হে আর্জন, তুমি ক্ষত্রিয়। ধর্মযুদ্ধই ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। এটা তোমার তোমার স্বধর্ম।৩১যে ক্ষত্রিয় এইরূপ ধর্মযুদ্ধ করে থাকেন, তিনি ভাগ্যবান,তিনি মুক্ত। তিনি স্বর্গলাভ করে থাকেন।৩২তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর তবে তোমার স্বধর্ম ও কীর্তি নষ্ট হবে, তোমার পাপ হবে।৩৩তথন তোমার দুর্নাম হবে। দুর্নাম অপেক্ষা মাননীয় মৃত্যুশ্রেয়ঃ।৩৪যেসকল বীর এখন তোমাকে সম্মান করে তখন ভীরু, কাপুরুষ- এই বলে তোমাকে উপহাস করবে।৩৫শত্রুগণও তোমার নিন্দা করবে। এটা অপেক্ষা দুঃখের আর কী হবে?৩৬এই ধর্মযুদ্ধে যদি তোমার মৃত্যু হয় তবে তুমি স্বর্গ পাবে, আর এই যুদ্ধে যদি জয়লাভ কর তবে তুমি পৃথিবী ভোগ করবে। অতএব হে অর্জুন, যুদ্ধের জন্য কৃতসংকল্প হও।৩৭সুখ-দুঃখ, লাভ-আলাভ ও জয়-পরাজয় সমান মনে করে তুমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।৩৮এতক্ষণ তোমাকে আত্মতত্ত্ব সম্পর্কে বললাম। এখন নিষ্কাম কর্ম সম্পর্কে বলছি, শ্রবণ কর।৩৯নিষ্কাম কর্ম কখনো নিষ্ফল হয় না, যতটুকু করা যায় ততটুকুই সার্থক হয়।৪০হে অর্জুন, নিষ্কাম কর্মী স্থিরচিত্ত, একনিষ্ঠ। আর সকামকর্মী অস্থিরচিত্ত। তার কামনাও বহু।৪১বেদোক্ত কর্মসকল সকাম কর্ম। বেদে সকাম কর্ম ভিন্ন অন্য কিছু করার নেই।৪২বেদোক্ত কর্মের লক্ষ্য স্বর্গপ্রাপ্তি। বেদবাদী তার কর্মের দ্বারা পুনর্জন্ম লাভ করে থাকেন।৪৩ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ সাংখ্যযোগ পৃষ্ঠা-২ বৈদিক কর্মকারীর কাম্য কেবল ভোগ, তাই বৈদিক কর্ম করে কেও ঈশ্বরে একনিষ্ট হতে পারে না।৪৪বেদ ত্রিগুণবিষয়ক- হে অর্জুন, তুমি গুণাতীত হও।৪৫জলপূর্ণ স্থানে যেরূপ কূপের প্রয়োজন হয় না, সেরূপ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তিরও বেদের প্রয়োজন নেই।৪৬কর্মেই তোমার আধিকার, কর্মফলে অধিকার নেই।৪৭অতএব কর্মফলের আশা না করে তুমি কর্ম করে যাও। ফলাফল সমজ্ঞানই যোগ।৪৮সকাম কর্ম নিকৃষ্ট, নিষ্কাম কর্ম শ্রেষ্ঠ। হে অর্জুন, যে ব্যক্তি ফলের আকাঙ্ক্ষায় কর্ম করে সে নিকৃষ্ট।৪৯জ্ঞানী ব্যক্তিপাপপুণ্যত্যাগী। কর্মের কৌশলকেই যোগ বলে। হে অর্জুন, তুমি যোগী হও।৫০জ্ঞানীগণ কখনো কর্মফল চান না। তাঁরা কর্মের বন্ধন হতে মুক্তি লাভ করেন।৫১নিষ্কাম কর্ম করতে করতে বাসনা দূর হবে। বাসনা দূর হলে মন স্থির হবে।৫২নিষ্কাম কর্মের দ্বারা যখন তোমার মন স্থির হবে তখনই অভ্যাস বশে তোমার যোগ লাভ হবে।৫৩অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি বলতে কাকেবুঝায়? তার লক্ষণ কী? সে কীরূপে কার্যাদি করে?৫৪শ্রীকৃষ্ণ বললেন- যিনি সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে সর্বদা সন্তুষ্ট থাকেন তিনিই স্থিরবুদ্ধি।৫৫যার চিত্ত সংযত এবং চিত্ত প্রসন্ন নয়, তার সুখ শান্তি লাভ হয়।৬৬বাতাস যেমন সমুদ্রে নৌকা ডুবিয়ে দেয়, সেরূপ ইন্দ্রিয়গণও অসংযত ব্যক্তির মন হরণ করে থাকে।৬৭ইন্দ্রিয়গণ সর্বপ্রকারের বিষয় হতে নিবৃত্ত হলে মন স্থির থাকে।৬৮আত্মদর্শী ব্যক্তি যাতে জাগ্রত থাকেন, বিষয়ী ব্যক্তি তাতে নিদ্রিত থাকে। বিষয়ী ব্যক্তি যাতে নিদ্রিত থাকে, আত্মদর্শী ব্যক্তি তাতে জাগ্রত থাকেন।৬৯সমুদ্র মধ্যে যত নদীই প্রবেশ করুক না কেন সমুদ্র স্থিরইথাকে। সেই যোগী ব্যক্তি সকল কামনার মধ্যেও স্থির থাকেন,কিন্তু কামনাপরায়ণ ব্যক্তি স্থির থাকতে পারে না।৭০যিনি কামনা ত্যাগ করেন তিনি নিঃস্পৃহ। নিঃস্পৃহ ব্যক্তি শান্তি লাভ করেন।৭১হে অজুন, এটিই ব্রাহ্মীস্থিতি (অর্থাত্ ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থান)। এই অবস্থা প্রাপ্তিতে মোহ দূর হয়ে মোক্ষ লাভ হয়।৭২ * সাংখ্যযোগ সমাপ্ত * তৃতীয় অধ্যায়ঃ কর্মযোগ অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, যদি কর্ম অপেক্ষা জ্ঞান বড় হয় তবে তুমি আমাকে যুদ্ধ করতে বলছ কেন?১তোমার দুই প্রকার কথায় আমার মন মোহিত হচ্ছে। যে পথে আমার মঙ্গল হবে সেই পথটি আমাকে বল।২শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, জ্ঞানীদের জ্ঞান ও কর্মীদের কর্ম- এই দুই প্রকার নিষ্ঠার কথা তোমাকে পূর্বে বলেছি।৩কর্ম না করে কেউ কর্ম বন্ধন হতে মুক্ত হতে পারে না। কর্মত্যাগ করলেই সিদ্ধি লাভ হয়না।৪কর্ম না করে কেউ ক্ষণকালও থাকতে পারে না। জীব প্রকৃতির প্রভাবেই কাজ করতে বাধ্য হয়।৫যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয় সংযত রেখেও বিষয়ের চিন্তা করে, সে ব্যক্তি মূর্খ। সকলে তাকে মিথ্যাচারী বলে থাকে।৬হে অর্জুন যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয় সংযত অথচ যিনি ফলাকাঙ্ক্ষী নন, সেই কর্মযোগীই প্রসংশার পাত্র।৭সর্বদা কর্ম করবে। শরীর রক্ষার জন্যেও কর্ম করা প্রয়োজন।৮হে অর্জুন, আসক্তি ত্যাগ করে ভগবানের প্রীতির জন্য কর্মকর। নতুবা বন্ধন ঘটবে।৯ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্ট করে বললেন- “তোমরা সর্বদা যজ্ঞ করিও। সর্বদা যজ্ঞ করিলে ইষ্ট লাভ হইবে।”১০যজ্ঞ দ্বারা দেবগণকে সন্তূষ্ট কর। তাতে ইষ্ট লাভ হবে।১১তখন লোকে কর্মহীন হয়ে উচ্ছন্নে যাবে, প্রজা নষ্ট হবে। ফলে আমি সঙ্করের কারণ হব।২৪অজ্ঞান ব্যক্তি ফল লাভের আশায় কর্ম করে। আর জ্ঞানী ব্যক্তি ফলের আশা ত্যাগ করে লোক শিক্ষার জন্য কর্ম করে।২৫জ্ঞানী ব্যক্তি মুখে কিছু না বলে কর্ম করে যাবেন। নিজে কর্ম করে তিনি ফলাসক্ত অজ্ঞান ব্যক্তিকেও কর্মে নিয়োজিত করবেন।২৬প্রকৃতির গুণে কর্ম করা হয়। অথচ অজ্ঞান ব্যক্তি বলে, “আমি কর্ম করি।”২৭অজ্ঞান ব্যক্তি প্রকৃতির প্রভাবে মুগ্ধ থাকে। জ্ঞানী ব্যক্তি তাকে বিচলিত করবেন না।২৮হে অর্জুন, সর্ব কর্ম আমাকে সমর্পণ করে এবং কামনাহীন ও মমতাহীন হয়ে তুমি যুদ্ধ কর।২৯আমার বাক্যে শ্রদ্ধাবান হয়ে কর্ম করেও কর্মী চিরদিন মুক্ত থাকে।৩০যে আমার বাক্য পালন করে না বরং আমার দোষ ধরে, সে অজ্ঞান ব্যক্তি, অবিবেকী। তাকে নষ্ট বলে জানবে।৩১জ্ঞানী ব্যক্তিও প্রকৃতির প্রভাবে চালিত হয়। কামনাশূন্য না হলে ইন্দ্রিয় দমন করে কী লাভ?৩২প্রাণিগণ প্রকৃতির অনুসরণ করে। জ্ঞানবান ব্যক্তিও নিজের প্রকৃতির অনুরূপ কর্ম করে থাকেন।৩৩বিষয়ের ভোগের দ্বারা ভোগের বাসনা বাড়ে, কমে না। এতে মুক্তি নষ্ট হয়।৩৪নিজ ধর্ম দোষযুক্ত হলেও পর ধর্ম হতে শ্রেষ্ঠ। নিজ ধর্মেমৃত্যু হলেও ভালো।৩৫অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, অনিচ্ছুক ব্যক্তি পাপ করে কেন? তাকে পাপ করায় কে?৩৬শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, কাম ও ক্রোধ দুইটি দুর্জয় রিপু। রজোগুণ হতে এদের উত্পত্তি। এরা মোক্ষের বিরোধী।৩৭যেমন মল দর্পণকে, ধুম অগ্নিকে, জরায়ু গর্ভকে ঢেকে রাখে, কামও সেইরূপ জ্ঞানকে ঢেকে রাখে।৩৮হে অর্জুন কাম জ্ঞানীর চিরশত্রু। এটি জ্ঞানীর জ্ঞান ঢেকে রাখে।৩৯মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়, এরা কামনার স্থান। কাম এই সকলকে আশ্রয় করে মানুষের জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে রাখে।৪০হে অর্জুন, আগে ইন্দ্রিয় সংযত কর। তবেই কামকে জয় করতে পারবে।৪১ইন্দিয়সকল বড়। ইন্দ্রিয়সকল অপেক্ষা মন বড়। মন অপেক্ষা বুদ্ধি বড়। বুদ্ধি অপেক্ষা আত্মা বড়।৪২হে অর্জুন, আত্মা সর্বশ্রেষ্ঠ। এটি বুঝে স্থির মনে কামরিপুকে দমন কর।৪৩ * কর্মযোগ সমাপ্ত * চতুর্থ অধ্যায়ঃ জ্ঞানযোগ এই জ্ঞানযোগ পূর্বে আমি সূর্যকে বলেছিলাম। সূর্য নিজ পুত্র মনুকে বলেছিলেন। এবং মনু ইক্ষুকে এটি বলেছিলেন।১পরম্পরাক্রমে রাজর্ষিগণও এই জ্ঞান লাভ করলেন। কালক্রমে এটি নষ্ট হয়ে গেল।২হে অর্জুন জ্ঞানযোগ অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়। তুমি আমার ভক্ত ও সখা। সেইজন্যই আমি তোমাকে এই জ্ঞান জানাচ্ছি।৩অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, আগে সূর্যের জন্ম, পরে তোমার জন্ম। তুমি কীভাবে সূর্যকে এই জ্ঞান শিক্ষা দিলে।৪শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, তোমার এবং আমার বহুজন্ম অতীত হয়েছে। আমার মনে আছে কিন্তু সেই সকল তোমার মনে নেই।৫আমার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। আমি সর্বভূতের ঈশ্বর। আমি নিজের মায়া বলে শরীর ধারণ করে থাকি।৬পৃথিবীতে যখনই ধর্মের গ্লানি হয় এবং পাপ বৃদ্ধি পায়, তখনই আমি শরীর ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হই।৭আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হয়ে সাধুদিগের পরিত্রাণ, পাপিদের বিনাস এবং ধর্ম সংস্থাপন করি।৮যে ব্যক্তি আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্মের কথা জানে সে ব্যক্তি মৃত্যুর পর আমাকে প্রপ্ত হন। তাঁহার আর পুনর্জন্ম হয় না।৯যে ব্যক্তি আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ ত্যাগ করে আমার শরণাপন্ন হয়, সে আমার ভাব প্রাপ্ত হয়। তার পাপ থাকে না।১০হে অর্জুন, যে ব্যক্তি যেভাবে আমার ভজন করে, সেই ব্যক্তিকে আমি সেইভাবে তুষ্ট করি।১১যে ব্যক্তি দেবতার পূজা করে সিদ্ধি লাভ করতে চায়, সে তা দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করে। কিন্তু সেই ব্যক্তি মুক্তি লাভকরতে পারে না।১২আমি গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র- এই চার বর্ণ সৃষ্টি করেছি। কিন্তু আমাকে অকর্তা ও অব্যয় বলেই জেনো।১৩আমি কর্ম করি কিন্তু আমি কর্মে লিপ্ত হই না। কর্ম ফলেও আমার স্পৃহা নেই। যারা এটি জানে তারা কর্ম বন্ধন হতে মুক্ত হয়।১৪পূর্বযোগীগণ এটি জেনে কর্ম করতেন। তুমিও তাঁদের মতই কর্ম করবে।১৫কর্ম অকর্মের বিচার করতে গিয়ে অনেক কর্মী অনেক ভুল করে থাকে। তাই তোমাকে কর্মতত্ত্ব বলছি।১৬কর্ম, অকর্ম ও বিকর্ম- কর্মের এই তিন গতি। সে সম্বন্ধে উপদেশ দিচ্ছি।১৭যে ব্যক্তি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখে সেই ব্যক্তিই প্রকৃত কর্মী। তিনিই বুদ্ধিমান।১৮যে কর্মী কামনা ত্যাগ করে কর্ম করে, জ্ঞানবলে তারা কর্মদগ্ধ হয়। সেই কর্মী পণ্ডিত ব্যক্তি।১৯তিনি আত্মতৃপ্ত ও নিরাশ্রয়। কামনা ছেড়ে কর্ম করেন বলে তিনি কর্ম করেও কর্ম করেন না। অর্থাত্ কর্মে লিপ্ত হন না।২০নিষ্কাম, সংযত ও পরিগ্রহত্যাগী ব্যক্তি দেহরক্ষার জন্যকর্ম করেও পাপভাগী হন না।২১সামান্য লাভে সন্তুষ্ট, ঈর্ষা, দ্বন্দ্বহীন এবং লাভ-অলাভে সমজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি কর্ম করেও কর্মের আধীন হন না।২২নিষ্কাম ও রাগ-দ্বেষাদিবর্জিত জ্ঞানী ব্যক্তি যজ্ঞ করলেও তার সর্বকর্ম লয় পায়।২৩যে ব্যক্তি অগ্নি হবিঃ (হোমের দ্রব্য) এবং যজ্ঞ সকলেকেইব্রহ্মময় মনে করেন তার সমস্তই ব্রহ্মে লয় পায়।২৪কর্মযোগী শ্রদ্ধার সাথে দৈবযজ্ঞ করেন। আর ফল ত্যাগী জ্ঞানী ব্রহ্মাকেই যজ্ঞ করেন।২৫কেউ ইন্দ্রিয়গণকে সংযমরূপ অগ্নিতে অর্পণ করে। আর কেউ বিষয়কে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে অর্পণ করে।২৬কেউ বা জ্ঞানের প্রভাবে আত্মসংযমরূপ অগ্নিতে ইন্দ্রিয়,মন প্রভৃতি দগ্ধ করে।২৭কোন কোন কর্মী দ্রব্যাদি দানরূপ কর্ম করেন, কেউ তপস্যারূপ যজ্ঞ করেন, কেউ যোগ আভ্যাসরূপ যজ্ঞ করেন এবং কেউ বা বেদ পাঠরূপ যজ্ঞ করে থাকেন।২৮কেউ প্রাণবায়ুতে আপন বায়ু এবং আপনবায়ুতে প্রাণবায়ু রূদ্ধ করে প্রণায়াম অভ্যাস করেন এবং তা দ্বারা ব্রহ্মের আরাধনা করেন।২৯কোন মিতাহারী ব্যক্তি প্রাণেই প্রাণাহুতি দেন। সেই ব্যক্তিই যজ্ঞবিদ। তিনি নিষ্পাপ।৩০যজ্ঞের শেষে অমৃত ভোজন করে যজ্ঞবিদ ব্যক্তি অন্তিমে ব্রহ্মলাভ করেন।৩১বেদে বহু যজ্ঞের বর্ণনা আছে। সেই সকল যজ্ঞ কর্মজনিত; এটি জেনে মুক্ত হওয়া যায়।৩২হে অর্জুন, দ্রব্যযজ্ঞ হতে জ্ঞানযজ্ঞ বড়। জ্ঞানের দ্বারা কর্মের শেষ হয়।৩৩তুমি প্রণাম, সেবা ও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি তোমাকে জ্ঞান উপদেশ দিবেন।৩৪সেই জ্ঞান লাভ করে তোমার মোহ দূর হবে। তখন আমার মধ্যে এবং তোমার নিজের মধ্যেই ভূতগণকে দেখতে পাবে।৩৫আর তুমি যদি পাপাচারী হয়ে পড়, জ্ঞানতরী আরোহণ করে তুমি পাপসিন্ধু পার হতে পারবে।৩৬হে অর্জুন, জ্বলন্ত আগুন যেমন কাঠকে দগ্ধ করে জ্ঞানরূপ আগুনও সেইরূপ সমস্ত কর্ম নষ্ট করে।৩৭জ্ঞানের মত পবিত্র আর কিছু নেই। কর্মযোগী যথাকালে আত্মজ্ঞান লাভ করেন।৩৮শ্রদ্ধাবান, জিতেন্দ্রিয়, ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করে মুক্তি লাভ করেন।৩৯যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাবান হয়েও সংশয়মুক্ত হয় না, সে মূর্খ।সে ব্যক্তির ইহলোকে পরলোকে সুখ লাভ হয় না।৪০যে কর্মী জ্ঞানে ভ্রান্তিহীন হয়ে নিষ্কাম কর্ম করে, সে আত্মজ্ঞ। সে কর্ম করলেও কর্মে আবদ্ধ হয় না।৪১হে অর্জুন, জ্ঞানরূপ অস্ত্রের দ্বারা সন্দেহ দূর কর। নিষ্কাম কর্ম কর, ওঠ।৪২ * জ্ঞানযোগ সমাপ্ত * পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্ম-সন্যাসযোগ অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তুমি কর্মত্যাগ করতে বলছ, আবার কর্ম করতেও বলছ। এই দুইটির মধ্যে যেটি আমার পক্ষে মঙ্গলজনক হবে সেটি বল।১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- কর্মত্যাগ ও কর্মযোগ দুটিই মুক্তিজনক। তবে কর্মত্যাগ অপেক্ষা কর্মযোগই ভালো, অর্থাত্ কর্মত্যাগ করা অপেক্ষা কর্ম করাই ভালো২যাঁর ইচ্ছা দ্বেষ নাই কিন্তু যিনি কর্ম করেন, তিনিই কর্মত্যাগীঁ। তিনি সহজেই বন্ধনমুক্ত হন।৩জ্ঞান ও কর্ম এক নয়- এটি অজ্ঞান ব্যক্তিদের কথা। প্রকৃতপক্ষে একটি দ্বারা দুইটির ফল লাভ করা যায়।৪কর্ম দ্বারা যা লাভ করা যায়, জ্ঞানেও তা লাভ করা যায়। তত্ত্বদর্শী ব্যক্তি জ্ঞান ও কর্মকে এক বলেই মনে করেন।৫কর্ম না করলে জ্ঞান লাভ করা যায় না। কর্মী কর্ম করেই ঈশ্বর লাভ করে থাকে।৬জিতেন্দ্রিয়, শুদ্ধচিত্ত, আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম করেন, কিন্তু কর্মে লিপ্ত হন না।৭“আমি কর্ম করি”- এই কথা কর্মযোগে মুক্ত, তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী ব্যক্তি ভাবেন না।৮জ্ঞানী ব্যক্তি উন্মেষ নিমেষ প্রভৃতি সমস্ত কর্মই ইন্দ্রিয়ের কাজ বলে মনে করেন। তাঁর কর্তৃত্বাভিমান নেই।৯যিনি ফলাকাঙ্ক্ষা ঈশ্বরে অর্পণ করে কর্ম করেন, তিনি নির্লিপ্ত ও নিষ্পাপ হন।১০ফলত্যাগী কর্মযোগী মন আদি ইন্দ্রিয় দ্বারা আত্মশুদ্ধি লাভ করার জন্যই কর্ম করে।১১ফলত্যাগী কর্মযোগী প্রকৃত শান্তি লাভ করেন। ফলাসক্ত কর্মী বদ্ধ হয়।১২ফলত্যাগী কর্মী নবদ্বারযুক্ত দেহে বাস করেন। তিনি নিজেও কর্ম করেন না, অন্যকে দিয়েও কর্ম করান না।১৩প্রকৃতি মানুষকে প্রবৃত্ত করে। ঈশ্বর কর্ম, কর্তৃত্ব বা কর্মফল কিছুই সৃষ্টি করেন না।১৪ঈশ্বর কারও পাপ-পুণ্য গ্রহণ করেন না। অজ্ঞানতা দ্বারা জ্ঞান আচ্ছন্ন থাকে। তাই জীব মোহগ্রস্ত হয়।১৫আত্মজ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞনতা দূর হয়, সেই ব্যক্তিই পরমতত্ত্ব জানতে পারে।১৬যার মনপ্রাণ আত্মজ্ঞানে নিষ্পাপ, সেই ব্যক্তি মুক্ত।১৭আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি ব্রাহ্মণে-চণ্ডালে, হাতিতে-কুকুরে সমান জ্ঞান করেন।১৮সমজ্ঞানী ব্যক্তি সংসার জয় করে থাকেন। ব্রহ্মকে জেনে তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন।১৯ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি কখনও ইষ্টে তুষ্ট বা অনিষ্টে রুষ্ট হন না।২০ব্রহ্মজ্ঞানীর মন ইন্দ্রিয় বিষয়ে অনাসক্ত। মৃত্যুর পর তিনি অনন্ত সুখ লাভ করেন।২১বিষয় ভোগে যে সুখ, তা অনিত্য ও দুঃখের কারণ। জ্ঞানী ব্যক্তি বিষয় সুখে তৃপ্ত থাকেন না।২২যিনি জিতেন্দ্রিয় তিনি মুক্তযোগী। তিনি সর্বদা সুখে থাকেন।২৩আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি অন্তরে সুখী হয়। তিনি ব্রহ্মে নির্বান লাভ করে থাকেন।২৪জিতেন্দ্রিয় কর্মযোগী নিষ্পাপ, দ্বিধাহীন ও সকলের হিতসাধনে রত থাকেন। তিনি সর্বদাই মুক্ত।২৫জিতেন্দ্রিয় আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি নির্বান লাভ করে থাকেন।২৬জিতেন্দ্রিয় আত্মজ্ঞানী বাহ্য চিন্তা দূর করে ভ্রুমধ্যে দৃষ্টিস্থাপন করতঃ প্রণায়ামের দ্বারা মোক্ষলাভের জন্য নিবিষ্ট হন।২৭-২৮হে অর্জুন, আমি যজ্ঞেশ্বর,আমি যোগেশ্বর, আমিই মহান ঈশ্বর, আমি জীবের বন্ধু- এটি জেনে জীব শান্তি লাভ করে।২৯ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ শ্রীকৃষ্ণ বললেন- কর্ম না করলে কেউ ত্যাগী হতে পারে না। যে ব্যক্তি ফলত্যাগী তিনিই সত্যিকার ত্যাগী।১সন্যাস ও কর্মযোগ- দুটিই এক। কামনা থাকা পর্যন্ত কেউই কখনও যোগী হতে পারে না।২যে ব্যক্তি যোগ লাভ করতে চান তিনি কর্মকে ধারণ করে থাকেন। আর যিনি যোগরূঢ় তিনি কর্ম ত্যাগ করেন।৩যিনি যোগরূঢ় তাঁর ভোগ আসক্তি ও কর্মের বন্ধন কিছুই থাকেনা। তিনি সর্বদা সর্ব বিষয়ে অনাসক্ত থাকেন।৪যোগরূঢ় ব্যক্তি আত্মা দ্বারা আত্মার উদ্ধার করবেন। তিনি কখনও আত্মাতে অবনতি প্রাপ্ত হতে দেবেন না। আত্মাই আত্মার বন্ধু, আত্মাই আত্মার শত্রু।৫যোগী পুরুষ আত্মজয়ী, আত্মা তাঁর বন্ধু। আর যার আত্মজ্ঞান নেই, আত্মা তার শত্রু।৬যোগী পুরুষ সর্বদাই সংযোমী ও উদার। শীত-তাপ, সুখ-দুঃখ ও মান-অপমানে তিনি বিচলিত হন না।৭যোগী ব্যক্তির মন জ্ঞান বিজ্ঞানে পরিতৃপ্ত থাকে। তাই তিনি স্বর্ণ ও লোষ্ট্রকে সমজ্ঞান করেন।৮পাপ-পুণ্য, শত্রু-মিত্র এবং সর্বজীবে যাঁর সমবুদ্ধি এবংযিনি দ্বেষহীন, তিনিই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।৯যোগীব্যক্তি নিঃস্পৃহ, জিতেন্দ্রিয় ও পরিগ্রহমুখ। তিনিসর্বদা নির্জনে বাস করেন।১০যোগী ব্যক্তি স্থির মনে সমতল স্থানে কুশাসনে উপবেশন করেন।১১যোগী ব্যক্তি কুশাসনে বসে সংযতচিত্তে যোগাভ্যাস করেন। তাতেই তাঁর আত্মশুদ্ধি হয়ে থাকে।১২যোগাভ্যাসকালে তাঁর দেহ অচঞ্চল, ঘাড় ও মাথা স্থির থাকবে। তাঁর দৃষ্টি নাসিকার অগ্রে স্থির থাকবে।১৩যোগী ব্যক্তি সর্বদা স্থিরচিত্ত, শান্ত ও ব্রহ্মচারী হবেন। তিনি নির্ভয়ে আমাতে আত্মনির্ভর করে থাকবেন।১৪এইভাবে যোগ সাধন করে যিনি চিত্ত জয় করেন, তিনি আমার মধ্যেই নির্বান ও শান্তি লাভ করেন।১৫অতি আহার, অনাহার, অতিনিদ্রা বা অতিজাগরণ- কোনটিতেই যোগ সাধনা হয় না।১৬যিনি নিয়মিত ভোগী, নিয়মিত আহারী, নিয়মিত কর্মী, নিয়মিত চেষ্টাশীল এবং যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত তাঁরই যোগ সাধন হয়ে থাকে।১৭যিনি সংযত, আত্মসমাহিত চিত্ত এবং সর্ব কর্মে স্পৃহাশূন্য তাঁরই যোগ সাধন হয়ে থাকে।১৮যে স্থানে শান্ত বায়ু সেখানে যেমন প্রদীপ শান্ত থাকে আত্মযুক্ত ব্যক্তিও সেরূপ সর্বদা সুস্থির থাকেন।১৯যোগযুক্ত ব্যক্তি চিত্তরোধ করে এবং শান্ত মনে আত্মদর্শন করে আনন্দ লাভ করেন।২০আত্মদর্শন হলে যোগীর মন স্থির হয়। এবং সেই অপূর্ব অবস্থায় বাক্যাতীত ও অতীন্দ্রিয় সুখ লাভ হয়ে থাকে।২১এই সুখ লাভ করলে অন্য সকল সুখই তুচ্ছ বোধ হয় তখন অতিশয় দুঃখেও মন বিচলিত হয় না।২২হে অর্জুন, যে-যোগে সুখ দুঃখের শেষ মাত্র নেই, তুমি সেই যোগ অভ্যাস করবে।২৩তুমি সমস্ত রকম কামনা ত্যাগ করবে এবং ইন্দ্রিয়গণকে সংযত করবে।২৪বুদ্ধি স্থির করে ধৈর্য ধারণ কর এবং চিন্তাশূন্য হয়ে মনসংযত কর।২৫মন চঞ্চল। সে নানা দিকে ধাবিত হয়। তাকে টেনে নিজের বশে আনতে চেষ্টা কর।২৬সেই যোগী রজোগুণহীন এবং যাঁর অন্তর প্রশান্ত, তিনিই সমাধিজনিত সুখ লাভ করে থাকেন।২৭নিষ্পাপ যোগী এইভাবে ব্রহ্মানন্দ প্রাপ্ত হয়ে অনায়াসে সুখ লাভ করেন।২৮যোগযুক্ত ব্যক্তি সর্বত্রই সমদর্শী হন। তিনি সর্বভূতে আত্মাকে এবং আত্মাকে সর্বভূতে দেখতে পান।২৯যে যোগী সকলের মধ্যে আমাকে এবং আমার মধ্যে সকলকে দেখেন, আমি কখনও তাঁকে হারাই না, তিনি কখনও আমাকে হারান না। ৩০আমি সর্বভূতে বিরাজ করি- এটি জেনে যে ব্যক্তি আমার ভজনা করে, সে ব্যক্তি যেভাবেই থাকুত না কেন আমার মধ্যে বিরাজ করে।৩১হে অর্জুন, যিনি সুখে দুঃখে সর্বজীবে সমদর্শী তিনিই যোগীশ্রেষ্ঠ।৩২অর্জুন বললেন- যে যোগের কথা তুমি আমাকে বললে আমার চঞ্চল মনে তা স্থায়ী হচ্ছে না।৩৩হে কৃষ্ণ, বড়ই চঞ্চল আমার এই মন। বাতাসের মত এই মনকে দমানো শক্ত।৩৪শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, এই চঞ্চল দুর্জয় মনকে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা বশে আনতে হয়।৩৫অসংযত ব্যক্তির পক্ষে মনকে বশে আনা কঠিন। কিন্তু সংযমী ব্যক্তির পক্ষে মনকে জয় করা কঠিন নয়।৩৬অর্জুন বললেন- যোগরূঢ় ব্যক্তি যদি যোগভ্রষ্ট হন তবে তারগতি কী হয়?৩৭যোগরূঢ় ব্যক্তি যদি জ্ঞানের পথ ও কর্মের পথ হতে ভ্রষ্ট হন, তাহলে তিনি কি ছিন্ন মেঘের মত নষ্ট হবেন না?৩৮হে কৃষ্ণ, তুমি দয়া করে আমার সন্দেহ দূর কর। হে দয়াময়, তুমি ছাড়া আর কে এই সন্দেহ দূর করবে?৩৯শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, যে ব্যক্তি শুভকাজে রত হয় তার ইহলোকে এবং পরলোকে দুর্গতি হয় না।৪০যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি মৃত্যুর পর বহু বছর পুণ্যলোকে বাস ক’রে পরজন্মে ধনীর ঘরে জন্মগ্রহণ করে।৪১অথবা সেই যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যবলে জ্ঞান যোগীর ঘরেওজন্মগ্রহণ করে থাকে।৪২সেই ব্যক্তি পূর্বজন্মের জ্ঞানের বলে পুনরায় মুক্তির জন্য চেষ্টা করে।৪৩সেই ব্যক্তি অভ্যাসের দ্বারা আবার যোগনিষ্ঠ হয় এবং বিষণ্ণ হতে দূরে থাকে।৪৪এভাবে বহু জন্ম সাধনা করে তিনি পাপ মুক্ত হয়ে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতঃ মোক্ষপ্রাপ্ত হন।৪৫হে অর্জুন, যোগী ব্যক্তি মুনি, জ্ঞানী ও কর্মী অপেক্ষা বড়। অতএব তুমি যোগ অবলম্বন কর।৪৬যে মদগতচিত্ত হয়ে আমার সেবা করে আমি তাকে শ্রেষ্ঠ যোগী বলে মনে করি।৪৭ * ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত * সপ্তম অধ্যায়ঃ জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমাতে মনপ্রাণ সমর্পণ করে যোগ অভ্যাস করলে তুমি আমাকে পাবে।১এই জ্ঞান আমি তোমাকে বলব। এটি জানলে এই পৃথিবীতে আর কিছু জানার বাকি থাকবে না।২এক হাজার লোকের মধ্যে কদাচিত কেউ আমাকে জানতে চায়। আর যারা আমাকে জানতে চায় তাদের কদাচিত কেউ আমাকে পেয়ে থাকে।৩ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, বুদ্ধি, মন, অহংকার এই আটটি আমার প্রকৃতি।৪হে অর্জুন, আমার প্রকৃতি দুই প্রকার- পরা ও অপরা। এরাই সংসার রক্ষা করছে।৫আমার এই দুই প্রকারের প্রকৃতি হতেই সমস্ত ভূতের উত্পত্তি। আর এই বিশ্বের সৃষ্টি ও সংহারের কর্তা আমি।৬হে অর্জুন, আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই। সূতদ্বারাযেমন মণিহার গাঁথা থাকে, এই বিশ্বও সেই রূপে আমাতে গাঁথা আছে।৭আমি চন্দ্র সূর্যের কিরণ, জলের রস, বেদের ওম, আকাশে শব্দ ও মানুষের পৌরুষ।৮আমি জীবের জীবন, পৃথিবীর পূতিগন্ধ, আগুনের তেজ এবং তপস্বীর তপস্যা।৯হে অর্জুন, আমি সনাতন। ভূতগণের বীজ, বুদ্ধিমানের বুদ্ধিএবং তেজস্বীর তেজ।১০আমি বলবানের বল, প্রাণিগণের কাম (বা অভিলাষ)।১১সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ- এই তিনটি গুণ আমা হতে জন্মে। এরা আমারঅধীন, কিন্তু আমি এদের অধীন নই।১২এই তিনটি গুণ দিয়ে আমি সংসারকে মুগ্ধ করে রেখেছি। অথবা নিত্য ও নির্বিকার আমাকে কেউ জানে না।১৩আমায় আশ্রিত না হলে ত্রিগুণময়ী মায়াকে কেউ ত্যাগ করতে পারে না।১৪মায়া দ্বারা জ্ঞান-আচ্ছন্ন সেই ব্যক্তি অসুরভাব প্রপ্তহয়।সে আমার ভজনা করেনা।১৫অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ,আর্ত, জ্ঞানী- এই চার পুণ্যবান ব্যক্তি আমার ভজনা করে।১৬এই চার জনের মধ্যে নিত্যযুক্ত ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ ভক্ত। আমি তাঁর প্রিয় ও তিনিও আমার প্রিয়।১৭নিত্যযুক্ত জ্ঞানী উদার। তিনি আমাকে আশ্রয় করে থাকেন। আমিই তাঁর গতি।১৮নিত্যযুক্ত জ্ঞানী বহু জন্ম পর বাসুদেব জ্ঞানে আমাতে ভজনা করে। ঈদৃশ জ্ঞানী ব্যক্তি পৃথিবীতে দুর্লভ।১৯নানা কামনায় যার জ্ঞান নাশ হয় সেই ব্যক্তি নানাভাবে অন্যদেবতার পূজা করে।২০যে ভক্ত অন্য যে দেবতাকে পূজা করতে চায় সেই দেবতাকে পূজা করার অচল ভক্তি আমিই তাকে দিয়ে থাকি।২১সেই ভক্ত ভক্তির সাথে সেই দেবতাকে পুজিয়াই ইষ্টফল লাভ করে।২২অন্য দেবতার পূজা ক’রে ভক্ত যে ইষ্টফল লাভ করে তা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আমার ভক্ত আমাকে চিরদিনের জন্য লাভকরে।২৩অজ্ঞান ব্যক্তি জানে না যে, আমি অব্যয় ও উত্তম। সেইজন্য সে ব্যক্তভাবে আমার উপাসনা করে।২৪আমি অজ অব্যয় এবং আদি-অন্তহীন। মায়ামুগ্ধ ব্যক্তি তা জানতে পারে না।২৫হে অর্জুন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভূতগণকে আমি জানি। কিন্তু আমাকে কেউ জানে না।২৬হে অর্জুন, সৃষ্টির পর হতে মোহ জন্মে। ফরে তারা মায়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে।২৭কিন্তু নিষ্পাপ পুণ্যবান ব্যক্তিগণ মোহযুক্ত হয়ে আমার ভজনা করে থাকে।২৮যে ব্যক্তি মুক্তিলাভের জন্য আশ্রিত হয়, সে ব্যক্তি অধ্যাত্ম ব্রহ্মকর্ম প্রভৃতি সবই জানতে পরে।২৯যে ব্যক্তি আমাকে অধিভূত, অধিদৈব ও অধিযজ্ঞ বলে জানে সে ব্যক্তি অন্তকালে আমাকেই স্মরণ করে।৩০ * সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত * অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষর-ব্রহ্মযোগ অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, ব্রহ্ম কী? অধ্যাত্ম কী? কর্ম কী? অধিভূত ও অধিদৈব কাকে বলে? এই সমস্ত আমাকে বল।১এ দেহে অধিযজ্ঞ কে? তিনি কী কাজ করেন? মানুষ মৃত্যুর পরতোমাকে কীভাবে পেতে পারে?২শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, পরমাত্মা ব্রহ্ম। জীবাত্মা অধ্যাত্ম। যজ্ঞাদিই কর্ম।৩অস্থায়ী বস্তু অধিবস্তু। ব্রহ্ম অধিদৈব। আমিই অন্তর্যামী অধিযজ্ঞ।৪যে ব্যক্তি আমার চিন্তা করতে করতে মারা যায় সে আমার ভাবই প্রাপ্ত হয়।৫মানুষ যা যা ভাবতে ভাবতে মারা যায় সে সেইভাব নিয়ে আবার জন্মগ্রহণ করে।৬আমাতে মন অর্পণ করে যুদ্ধ করে যাও। আমাতে মন অর্পণ করলেই তুমি অন্তে আমাকে পাবে।৭হে অর্জুন, যে অভ্যাসের দ্বারা মন স্থির করে সে-ই অন্তে পরম পুরুষ পাবে।৮সেই পরম পুরুষ অনাদি, অচিন্ত্য ও জ্যোতির্ময়। তিনি অতি সূক্ষ্ম। তিনি ব্রহ্মাণ্ডের পালক ও সকলের প্রভু।৯যে ব্যক্তি ভ্রূদ্বয়ের মধ্যে মন স্থির করে যোগ সাধনা করে সেই ব্যক্তিই পরম ব্রহ্মাকে লাভ করতে পারে।১০বেদজ্ঞ, যতি ও ব্রহ্মচারী ব্রহ্মকেই জানতে চায়। সেজন্য ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজন। অর্জুন, তা বলছি শোন।১১ইন্দ্রিয়গণকে রোধ করে মন স্থির করতে হয়। মন স্থির করে পরে যোগ অভ্যাস করতে হয়।১২যে ওম্ উচ্চারণ করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করে সে পরম গতি লাভ করে।১৩হে অর্জুন, যে যোগী একাগ্র চিত্তে আমাকে ডাকেন সেই যোগী সহজেই আমাকে পেয়ে থাকেন।১৪সেই যোগী মুক্তসিদ্ধ হয়ে আমাকে লাভ করেন। তিনি আর পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন না।১৫ব্রহ্মলোকে গেলেও সেখান হতে পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু আমাকে পেলে পুনর্জন্ম হয় না।১৬মানুষের এক হাজার চার যুগে ব্রহ্মার এক দিন এবং এইরূপ এক হাজার চার যুগে ব্রহ্মার এক রাত। জ্ঞানী ব্যক্তিরা তা জানেন।১৭দিবাভাগে ব্রহ্মা প্রকাশিত থাকেন। তখন জীবের সৃষ্টি হয়। রাতে ব্রহ্মা সুপ্ত থাকেন। সেই সময় জীবগণ লয়প্রাপ্ত হয়।১৮এভাবে জীব ব্রহ্মার দিনে জন্মগ্রহণ করে। ব্রহ্মার রাতেলয়প্রাপ্ত হয়।১৯পরমব্রহ্ম অব্যক্তেরও অতীত। তাঁর মৃত্যু নাই। তিনি নিত্য ও সনাতন।২০অব্যক্ত অক্ষর শ্রেষ্ঠ গতি। সেই আমার শ্রেষ্ঠ স্থান। তা পেলে পুনর্জন্ম হয় না।২১হে অর্জুন, পরব্রহ্ম সর্বব্যাপী। ভক্তি দ্বারা তাঁকে লাভ করা যায়।২২কোন্ সময় মারা গেলে পুনর্জন্ম হয় আর কোন্ সময় মারা গেলে মুক্তি লাভ হয়, তা বলছি শোন।২৩বছরের ছয় মাস কাল উত্তরায়ণ। এটি শুক্লপথ। এই সময় মারা গেলে ব্রহ্মকে পাওয়া যায়।২৪বছরের বাকি ছয় মাস দক্ষিণায়ন, এটি কৃষ্ণপথ। এই সময় মারা গেলে জীব স্বর্গলাভ করে এবং স্বর্গে কর্মফলভোগ করতঃ পুনরায় সংসারে ফিরে আসে।২৫এই দুইটি পথ চিরদিনই আছে। শুক্লপথে মুক্তিলাভ হয় এবং কৃষ্ণপথে সংসারে ফিরে আসতে হয়।২৬হে অর্জুন, এই দুই পথের সন্ধান জেনে যোগী পুরুষ মুক্তি লাভ করেন। অতএব তুমি যোগী হও।২৭যোগী পুরুষ বেদে, যজ্ঞে, তপস্যায় ও দানে কখনও পুণ্যফল চান না। তাই তিনি অন্তিমে পরম গতি লাভ করেন।২৮. * অষ্টম অধ্যায় সমাপ্ত * নবম অধ্যায়ঃ রাজবিদ্য-রাজগুহ্যযোগ শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমি বিজ্ঞানের সাথে ঈশ্বর বিষয়ক জ্ঞানের কথা বলছি। এটি জানলে তুমি হিংসাশূন্য হবে এবং সংসার দুঃখ হতে মুক্তি পাবে।১এই জ্ঞানের নাম রাজবিদ্যা। এটি পবিত্র, অক্ষয় ও অতি গোপনীয়। এটি অপরোক্ষ ও সখদায়ক।২যে ব্যক্তি এই জ্ঞান বিষয়ে শ্রদ্ধাহীন, সে আমাকে পায় না। তিনি মৃত্যুময় এই সংসারে বারবার যাতায়াত করেন।৩আমি অব্যক্তরূপে বিশ্ব ব্যাপিয়া আছি। ভূতগণ আমাতে অবস্থিত আছে কিন্তু আমি ভূতগণে অবস্থিত নই।৪আমার ঐশ্বরিক যোগ দেখ। আমি ভূতগণের ধারক ও পালক। কিন্তুআমি ভূতগণে অবস্থিত নই।৫সর্বগামী বাতাস যেমন আকাশে অবস্থিত সেইরূপ সৃষ্টি ও সৃষ্ট প্রাণীরা আমাতেই অবস্থিত থাকে।৬প্রলয়কালে ভূতগণ প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হয়। কল্পের আরম্ভে আমি তাদেরকে আবার সৃষ্টি করি।৭আমি আমার মায়া দ্বারাই কর্মাধীন জীবগণকে বার বার সৃষ্টি করি।৮হে অর্জুন, আমি অনাসক্ত হয়ে সৃষ্টি করি। এই জন্য আমার কর্মে বন্ধন ঘটে না।৯হে অর্জুন, প্রকৃতিই এই বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করে থাকে। তাই বার বার সৃষ্টি হয়।১০আমি যে মহেশ্বর তা মূর্খ ব্যক্তিরা বুজতে পারে না। বুজতে পারে না বলেই সে নবরূপধারী আমাকে তুচ্ছ বোধ করে।১১মূর্খ ব্যক্তি আসুরী প্রকৃতির বশবর্তী হয়ে এইরূপ করে। তার আশা, কর্ম ও জ্ঞান সবই বৃথা হয়। তার চিত্ত বিক্ষিপ্তথাকে।১২মহাপুরুষগণ দৈবী প্রকৃতির বশে অনন্যচিত্ত হয়ে থাকেন। তাঁরা আমাকে সনাতন জেনে একমনে আমারই ভজনা করেন।১৩তাঁরা নিয়ম, যত্ন ও প্রণাম করে প্রতিদিন ভক্তির সাথে আমার ভজনা করেন।১৪কেউ জ্ঞানযজ্ঞে আমার ভজনা করে। কেউ কেউ আবার নানাভাবে আমার উপাসনা করে।১৫আমি ক্রত, আমি যজ্ঞ, আমি মন্ত্র, আমি স্বধা, আমি অগ্নি, আমি হোম, আমিই ঘৃত। তুমি এটি জেনে রেখ।১৬আমি জগতের পিতামাতা। আমি কর্মের ফলদাতা। আমি পবিত্র ওঙ্কার। আমি পিতামহ। আমি বিধাতা।১৭আমি প্রভু, আমি সাক্ষী, আমি গতি, আমি ভর্তা, আমি প্রভা ও প্রলয়ের স্থান। আমি সবকিছুর কারণ।১৮হে আর্জুন, আমি তাপ দান করি, আমি জল বর্ষণ করি, আমি স্থূল ও সূক্ষ্ম, আমি জীবের জন্ম এবং আমিই জীবের মৃত্যু।১৯সোমপায়ী ব্যক্তি যজ্ঞ করে স্বর্গসুখ লাভ করতে চায়। সে ইন্দ্রলোকে গিয়ে দেবভোগ্য লাভ করে।২০পুণ্য শেষ হলে ঈদৃশ ব্যক্তির সুখভোগও শেষ হয়। এভাবে সকামী ব্যক্তি বার বার সংসারে জন্মগ্রহণ করে আর মারা যায়।২১যে ব্যক্তি এক মনে আমার ভজনা করে আমি তার যোগক্ষেম বহন করি।২২হে অর্জুন, যে ব্যক্তি ভক্তির সাথে অন্য দেবতার পূজা করে সেই ব্যক্তিও বিধিহীনভাবে আমারই ভজনা করে।২৩আমি সর্বযজ্ঞের ভোক্তা ও কর্মের ফলদাতা। মূর্খ ব্যক্তিতা না জেনে বার বার সংসারে ঘুরে থাকে।২৪আন্য দেবতাকে পূজা করে স্বর্গ পাওয়া যায়। শ্রাদ্ধ করে পিতৃলোক পাওয়া যায়, ভূতগণের পূজা করে ভূতলোক পাওয়া যায়।কিন্তু আমার ভক্ত আমাকে পায়।২৫পত্র, পুষ্প, ফল, জল ভক্তির সাথে আমাকে অর্পণ করলে আমি সেই সকল গ্রহণ করি।২৬হে অর্জুন, তপস্যা, কর্ম, হোম, খাদ্য, দান- সমস্তই আমাতে অর্পণ কর।২৭তাতে তুমি শুভাশুভ কর্মফল হতে মুক্ত হবে এবং সন্যাসযোগের দ্বারা আমাকে পাবে।২৮আমার কাছে প্রিয়-অপ্রিয় নেই। আমার কাছে সকলেই সমান। যে আমার ভজনা করে আমি তার এবং সেও আমার।২৯দুষ্ট ব্যক্তিও যদি এক মনে আমার পূজা করে তবে তার কর্মনিষ্ঠা সাধু হয় এবং সে সজ্জন বলে পরিগণিত হয়।৩০সে ধর্মপ্রাণ হয়ে চিরদিন সুখে থাকে। হে অর্জুন, আমার ভক্ত কখনও নাশপ্রাপ্ত হয় না।৩১বৈশ, শূদ্র, নারী এমনকি হীনজাতির লোকও আমার ভজনা ক’রে শ্রেষ্ঠগতি লাভ করে।৩২ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও সজ্জন ব্যক্তি আমাকে পাবে। অতএব, হে অর্জন, তুমি সর্বদা একমনে আমার ভজনা কর।৩৩হে অর্জুন, তুমি ভক্তির সাথে আমাকে নমস্কার কর, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে পাবে।৩৪. * নবম অধ্যায় সমাপ্ত * দশম অধ্যায়ঃ বিভূতিযোগ শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, তোমাকে আমার পরমার্থ তত্ত্ব বলছি। শুনলে তুমি প্রীত হবে। তাই বলছি।১মহর্ষীগণ আমার এই পরমার্থতত্ত্ব জানেন না। সমস্তভাবেই আমি সকলের আদি।২আমার জন্ম নাই- আদি অনাদি ও সর্বলোক মহেশ্বর যে ব্যক্তি এই তত্ত্ব জানে, সে পাপমুক্ত হয়।৩বুদ্ধি, জ্ঞান, অমূঢ়তা, ক্ষমা, সত্য, শম, দম, জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ, নিন্দা, যশ, অহিংসা ,সমতা, তুষ্টি, তপঃ, দান, ভয়- এই কয়টি জীবের ভাব। জীবগণ আমা হতেই এই ভাবগুলো পেয়ে থাকে।৪-৫সপ্ত ঋষি ও পূর্ব চার মনু আমার মানস সৃষ্টি। তারা প্রজা সৃষ্টি করেছেন।৬যে ব্যক্তি আমার বিভূতিযোগ জানে সে ব্যক্তি সমাধীযোগে রত হয়।৭আমা হতে এই জগতের প্রবর্তন- তা জেনে জ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে ভজনা করেন।৮আমার ভক্ত আমাতে মনপ্রাণ সমর্পণ করে শান্তি ও তৃপ্তি লাভের জন্য আমার প্রসঙ্গ কীর্তন করে।৯আমি সেই সকল ভক্তকে আমার মনমত ভক্তি দিয়ে থাকি। সেই জ্ঞানের সাহায্যে তারা আমাকে লাভ করে থাকে।১০আমি আত্মারূপে তাদের মধ্যে বাস করি এবং অনুগ্রহ করে তাদেরকে তত্ত্ব জ্ঞান দান করি। তাদের অজ্ঞানতাজনিত অন্ধকার দূর করি।১১আর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, পরব্রহ্ম, পরধাম, শ্বাশ্বত পুরুষ, আদিদেব, আজ, বিভু- সবই তুমি।১২দেবর্ষি নারদ, ব্যাস, অসিত, দেবল প্রভৃতি যা বলেন তুমিও তাই বল।১৩তুমি যে বললে, দেবগণ ও দৈত্যগণ তোমার উত্পত্তি জানেন- তুমি এটি ঠিকই বলেছ।১৪তুমি জগতের পতি। তুমি ভূতগণের প্রভু। তুমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে জানতে পারে না।১৫বিশ্বময় কেবল তোমারই বিভূতি। তোমার বিভূতির কথা আমাকে বিস্তৃতভাবে বল।১৬তোমাকে কীভাবে ভাবব ও কীভাবে চিন্তা করব তা আমাকে খুলে বল।১৭তোমার বিভূতির কথা আমার খুবই ইচ্ছা হচ্ছে। তুমি তা খুলেবল।১৮শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমার বিভূতির শেষ নেই। বলছি শুন।১৯হে অর্জুন, আমি আত্মারূপে সকলের মধ্যে বিরাজ করি। ভূতগণের আদি, অন্ত ও মধ্য- সমস্তই আমি।২০আমি আদিত্যগণের মধ্যে বিষ্ণু, নক্ষত্রগণের মধ্যে তপন, মরুত্গণের মধ্যে মরীচি, জ্যোতিস্কগণের মধ্যে চন্দ্র।২১আমি বেদের মধ্যে সাম বেদ, ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে মন, দেবগণের মধ্যে ইন্দ্র ও জীবগণের মধ্যে চেতনা।২২আমি পর্বতের মধ্যে সুমেরু, যক্ষগণের মধ্যে কুবের, বসুগণের মধ্যে অনল ও রুদ্রগণের মধ্যে শিব।২৩পুরোহিতগণের মধ্যে বৃহস্পতি, জলাশয়গণের মধ্যে রত্নাকর, সেনানীর মধ্যে কার্তিক।২৪আমি মহর্ষিগণের মধ্যে ভৃগু, বাক্যের মধ্যে ওঙ্কার, যজ্ঞের মধ্যে জপযজ্ঞ, ও স্থাবরের মধ্যে হিমালয় পর্বত।২৫দেবর্ষিগণের মধ্যে আমি নারদ, সিদ্ধগণের মধ্যে কপিল মুনি, গন্ধর্বগণের মধ্যে চিত্ররথ এবং বৃক্ষের মধ্যে অশ্বত্থ।২৬অশ্বের মধ্যে আমি উচ্চৈঃশ্রবা, গজমধ্যে ঐরাবত এবং নরগণের মধ্যে রাজা।২৭আমি ধেনুগণের মধ্যে কামধেনু, অস্ত্রের মধ্যে বজ্র, সর্পের মধ্যে বাসুকি ও সৃষ্টিতে কাম।২৮আমি নাগের মধ্যে অনন্ত, জলচরগণের মধ্যে বরুণ, পিতৃগণের মধ্যে অর্যমা ও সংযমনের মধ্যে যম।২৯আমি দৈত্যের মধ্যে প্রহ্লাদ, গণনাতে কাল, পশুর মধ্যে সিংহ এবং পাখীর মধ্যে গরুড়।৩০বেগগামীর মধ্যে আমি বাতাস, মীনের মধ্যে মকর, শাস্ত্রধারীগণের মধ্যে রাম, এবং নদীর মধ্যে জাহ্নবী।৩১আমি সৃষ্টির আদি, অন্ত ও মধ্য, বিদ্যার মধ্যে আত্মবিদ্যা এবং বাদীদের বাদ।৩২সমাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অক্ষরের মধ্যে অ-কার, আমি অক্ষয়কাল এবং সকলের বিধাতা।৩৩আমি সর্বহারী মৃত্যু। আমি ভবিষ্যত্ সৃষ্টি, কীর্তি স্মৃতি, মেধা ও ক্ষমা প্রভৃতি।৩৪আমি সামের মধ্যে বৃহত্ সাম, ছন্দের মধ্যে গায়ত্রী, মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাস এবং ঋতুর মধ্যে বসন্ত।৩৫আমি তেজস্বী তেজ, বঞ্চকের দূত, জয়ের চেষ্টা এবং সাত্ত্বিকের সত্ত্বা।৩৬বৃঞ্চিকূলের মধ্যে আমি বাসুদেব, মুনিদের মধ্যে ব্যাস, পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন এবং কবিদের মধ্যে শুক্র।৩৭আমা জয়ার্থী নীতি। শাসকের দণ্ড, গুহা মধ্যে মৌন এবং তত্ত্বজ্ঞানীর জ্ঞান।৩৮আমি ভূতগণের বীজ। এই চরাচরে আমি ছাড়া আর কিছুই নেই।৩৯হে অর্জুন, আমার অনন্ত বিভূতি তোমাকে সংক্ষেপে বললাম।৪০এই বিশ্বে প্রভাব, বিভূতি, বল, শ্রী- সবই আমার অংশ হতে উত্পন্ন।৪১হে অর্জুন, আমি এক অংশ দিয়ে বিশ্ব-সংসার ধারণ করে আছি। এর অধিক আর জেনে কী হবে?৪২ * দশম অধ্যায় সমাপ্ত * একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ দর্শনযোগ অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তোমার কৃপায় অধ্যাত্মতত্ত্ব শুনে আমার মোহ দূর হল।১তুমি সৃষ্টি ও লয়ের কথা বলেছ। তোমার অব্যয় মাহাত্ম্যও সবিস্তারে শুনেছি।২তুমি তোমার স্বরূপ যা বললে তা সবই সত্য। তোমার ঐশি মূর্তি দেখবার জন্য আমর খুব ইচ্ছা হচ্ছে।৩হে দয়াময়, তুমি যদি আমাকে তোমার ঐশি মূর্তি দেখবার উপযুক্ত মনে কর, তবে দয়া করে আমাকে তা দেখাও।৪শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমার শত সহস্র বর্ণ দেখ।৫আমার দেহ অশ্বিনীকুমার দ্বয়, বায়ুগণ, আদিত্যগণ, বসুগণ ও রুদ্রগণকে দেখ।৬নিখিল জগত্ আমার মধ্যেই বিদ্যমান। তুমি আমার মধ্যে আরও যা দেখতে চাও চেয়ে দেখ।৭চর্ম-চক্ষুতে আমাকে দেখা সম্ভব নয়। তাই তোমাকে জ্ঞান-চক্ষু দান করছি।৮সঞ্জয় বললেন- হে মাহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, এই কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ নিজের দিব্যরূপ দেখালেন।৯অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের বহুমুখ, বহুচক্ষু এবং দিব্য-অস্ত্রশস্ত্র, দিব্য-অলংকারে শোভিত তাঁর অদ্ভুত মূর্তিদেখলেন।১০অর্জুন দেখলেন- শ্রীকৃষ্ণ দিব্য বস্ত্র-মাল্যধারী এবং সুগন্ধে চর্চিত, সর্বাশ্চার্যময় ও অনন্ত।১১এক হাজার সূর্য যদি আকাশে উদিত হয় তবে শ্রীকৃষ্ণের রূপের তুলনায় হাজার সূর্যের রূপ কিছু নয়।১২অর্জুন নানাভাবে বিভক্ত বিশ্বকে শ্রীকৃষ্ণের দেহে একত্রিত দেখতে পেলেন।১৩এই অদ্ভুত রূপ দেখে অর্জুন রোমাঞ্চিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে করজোড়ে বললেন।১৪অর্জুন বললেন- হে দেব, আমি তোমার মধ্যে দেবগণ, ঋষিগণ, সর্পগণ, সর্বভুত ও পদ্মাসন ব্রহ্মাকে দেখতে পাচ্ছি।১৫আমি তোমার অনন্ত উদর, অনন্ত নেত্র ও অনন্ত বাহু দেখছি। আমি তোমার বিশ্বরূপ দেখছি। তোমার এই রূপ আদিহীন, মধ্যহীন ও অনন্ত।১৬তুমি চূড়া, গদা ও চক্রধারী। সর্বদিকে তুমি উজ্জ্বল। তেজে তুমি সূর্য ও অগ্নির তুল্য। তোমাকে নিরীক্ষণ করা সম্ভব নয়।১৭তুমি সনাতন। তুমি অব্যয় অক্ষর। তুমি সর্বরক্ষাকারী ও জগতের আশ্রয়।১৮তোমার অনন্ত বাহু, অনন্ত নেত্র। তোমার দুই চোখে সূর্য ও চন্দ্রের জ্যোতি। তোমার আগুনের মত উজ্জ্বল তেজে নিখিল জগত্ উত্তপ্ত হচ্ছে।১৯তুমি একাই সমস্ত বিশ্ব ব্যাপিয়া আছ। তোমার উগ্ররূপ দেখে ত্রিলোক ভীত হচ্ছে।২০ত্রিলোকবাসী ও দেবগণ ভয়যুক্ত হচ্ছে। ঋষিগণ ও সিদ্ধগণ তোমার স্তব করছেন।২১বসুগণ, রুদ্রগণ, সিদ্ধগণ সকলেই তোমার রূপ দেখে অতিশয় মুগ্ধ হচ্ছে।২২তোমার বহু মুখ, বহু চোখ, বহু বাহু, উরু দেখে ত্রিলোক ও আমি ভীত হয়েছি।২৩তোমার নানাবর্ণযুক্ত তেজোদীপ্ত বিশ্বব্যাপী রূপ দেখে হৃদয়ে ভয় হচ্ছে।২৪হে কৃষ্ণ, কালাগ্নিতুল্য তোমার করাল বদন ও দাঁত দেখে আমি ভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। আমার মনে বিন্দুমাত্র সুখও নাই।২৫ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, রাজগণ এবং আমাদের পক্ষেরও কত বীর দেখতে পাচ্ছি।২৬তাঁরা অধীরভাবে তোমার মুখে প্রবেশ করছেন। তাঁদের কারও মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে, কেউবা তোমার ভয়ংকর দাঁতে আটকা পড়ে আছে।২৭নদীর স্রোত যেমন সাগরে প্রবাহিত হয় এইসব বীরগণও সেইরূপ তোমার মুখে প্রবেশ করছে।২৮পতঙ্গ আগুনে প্রবেশ করে মারা যায়। এই বীরগণও তেমনি মৃত্যুর জন্যই তোমার মুখে প্রবেশ করছে।২৯তুমি জ্বলন্ত বদনে সকলকে ভক্ষণ করছ এবং সমস্ত বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে দগ্ধ করছ।৩০হে উগ্ররূপী, তুমি কে? হে দেব, তুমি দয়া করে তোমার পরিচয় দাও। আমি তোমাকে প্রণাম করছি।৩১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমি লোকক্ষয়কারী ভয়ংকর কাল। তুমি তোমার শত্রুগণকে না মারলেও তাঁরা মারা যাবে।৩২হে অর্জুন, উঠ। যুদ্ধ কর। যশ লাভ কর। আমি সকলকে মেরে রেখেছি। তুমি উপলক্ষমাত্র হও।৩৩ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, জয়দ্রোথ- সকলকেই আমি মেরে রেখেছি। অতএব তুমি যুদ্ধ কর।৩৪সঞ্জয় বললেন- শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে ভীত অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে করজোড়ে বললেন।৩৫অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তোমার নাম গান করে জগদ্বাসী পরিতুষ্ট। রাক্ষসগণ তোমার নামে দূরে পলায়ন করে। সিদ্ধগণ তোমার প্রণাম করে।৩৬তুমি অনাদি অনন্ত ব্রহ্ম। তুমি বিশ্বময়। তুমি ব্রহ্মারও পূর্ববর্তী। তুমি জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞাতব্য বিষয়।৩৭হে প্রভু, তুমি আদিদেব। তুমি প্রধান পুরুষ, সমগ্র বিশ্ব তোমার মধ্যে বিরাজমান।৩৮তুমি ব্রহ্মা, তুমি বরুণ, প্রপিতামহ প্রভৃতি- সব তুমি। হে অনাদি দেব, আমি তোমাকে নমস্কার করি।৩৯আমি সামনে, পিছনে ও সবদিকে তোমাকে প্রণাম করছি। হে দয়াময়, তুমি অনন্ত, তুমি সকলের প্রভু।৪০না জেনে বার বার “হে কৃষ্ণ, হে যাদব, হে সখা”- এইরূপ বলে তোমাকে কতই অবজ্ঞা করেছি।৪১আহারের সময়, ঘুমের সময়, এবং আরও অনেক সময় আমি তোমাকে কত অবজ্ঞাই না করেছি। হে দয়াময়, তুমি আমার এই সকল দোষ ক্ষমাকর।৪২তুমি বিশ্বের পিতা। তুমি শ্রেষ্ঠ গুরু। তুমি সকলের পূজ্য। বিশ্ব-সংসারে তোমার তুলনা মেলে না।৪৩পিতা পুত্রের, বন্ধু বন্ধুর এবং স্বামী যেমন স্ত্রীর দোষ ক্ষমা করে, তুমিও সেইরূপ আমাকে ক্ষমা করিও।৪৪তোমার এই বিশ্বরূপ অপূর্ব। কিন্তু এটি দেখে আমার ভয় হচ্ছে। তুমি দয়া করে আমাকে তোমার পূর্বরূপ দেখাও।৪৫হে প্রভু, তুমি বিশ্বরূপ ত্যাগ করে চতুর্ভুজধারী হয়ে আবার দেখা দাও।৪৬শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে আমার দীপ্ত বিশ্বরূপ দেখালাম।৪৭বেদ, যজ্ঞ, তপস্যা প্রভৃতি নানা-বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেও তুমি ছাড়া কেউ এর সন্ধান পায় না।৪৮আমার উগ্ররূপ দর্শন করে তোমার যে ভয় হয়েছে তা এখন দূর হবে। তুমি এখন আমার পূর্বরূপ দর্শন কর।৪৯সঞ্জয় বললেন- হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, এই কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিজের পূর্বরূপ দেখালেন।৫০অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তোমার এই নবরূপ দেখে আমি প্রকৃতিস্থ হলাম। আমার মন-প্রাণ প্রসন্ন হল।৫১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমার এই দুর্লভ রূপ দেখার জন্য দেবগণ সর্বদাই ইচ্ছা করেন।৫২বেদপাঠ, যজ্ঞ কিংবা দান করে কেউ আমার এরূপ দর্শন করতে পারে না।৫৩আমাতে যার একনিষ্ঠ ভক্তি হয়- সেই ব্যক্তি আমার রূপ দেখতে পারে। সেই ব্যক্তিই আমার প্রিয়।৫৪হে অর্জুন, আমার ভক্ত অনাসক্তভাবে সিংসা ছেড়ে আমার কর্মকরেই আমাকে পেয়ে থাকে৫৫ একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত দ্বাদশ অধ্যায়ঃ ভক্তিযোগ অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, ভক্তি দ্বারা তোমার ভজনা আর অব্যক্ত ব্রহ্মের ভজনা- এই দুটির মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ?১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, যাঁরা যোগযুক্ত তাঁরা আমাতেই চিত্ত অর্পণ করেন। তাঁরা ভক্তি দ্বারা আমার পূজা করেন। তাঁরাই যোগীশ্রেষ্ঠ।২পরমব্রহ্ম অব্যয় ও সর্বব্যাপী। তিনি কুটস্থ, অচল ও সংজ্ঞাতীত।৩সর্বভূতহিতে রত জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিগণ সেই কুটস্থ ব্রহ্মের উপাসনা ক’রে আমাকেই লাভ করে থাকেন।৪অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা খুবই কষ্টকর। মানুষ কষ্টে তাতে ফল লাভ করে।৫কেউ কেউ সর্বকর্ম আমাতে সমর্পণ ক’রে মন প্রাণ দিয়ে ভজনা করেন।৬তাঁরা আমাতেই প্রাণ সমর্পণ করে থাকেন। আমি তাঁদেরকে সংসার সাগর হতে ত্রাণ করি।৭তুমি মন ও বুদ্ধি আমাতে স্থির কর। তা হলে মৃত্যুর পর আমাকে পাবে।৮হে অর্জুন, যদি আমাতে মন বুদ্ধি স্থির করতে না-ই পার তবে অভ্যাসের দ্বারা চেষ্টা কর।৯যদি অভ্যাস করতেও অসমর্থন হও তবে আমার প্রীতির জন্য আমার কাজ কর।১০হে অর্জুন, যদি তাও না পার তবে সর্বকর্মফল ত্যাগ করে মদযুক্ত হও।১১অভ্যাস হতে জ্ঞান বড়, জ্ঞান হতে ধ্যান বড়, ধ্যান হতে ফলত্যাগ বড়। ফলত্যাগ করতে পারলেই শান্তি পাওয়া যায়।১২আমার ভক্ত সুখে দুঃখে সম, অহংকার ও মমত্বহীন এবং দয়া,মৈত্রী ও ক্ষমাযুক্ত হয়ে থাকেন।১৩আমার ভক্ত জিতেন্দ্রিয়, দৃঢ় নিশ্চয় ও মন-বুদ্ধি আমাতে অর্পণ ক’রে সর্বদা সন্তুষ্ট থাকেন।১৪যিনি অন্যকে উদ্বিগ্ন করেন না এবং নিজেও উদ্বিগ্ন হন নাএবং হর্ষ-দ্বেষ ও ভয়মুক্ত তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত।১৫যে যোগী নিঃস্পৃহ, নিরপেক্ষ, সর্বদা পবিত্র, দক্ষ ও সর্বত্যাগী তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত।১৬যাঁর ইচ্ছা, দ্বেষ, শোক ও ভয় নাই এবং শুভ-অশুভ পরিত্যাগী সেই ভক্তই আমার প্রিয়।১৭আমার প্রিয় ভক্তের শীত-উষ্ণে, সুখ-দুঃখে, মান-অপমানে এবংশত্রু-মিত্রে সমান ভাব। তাঁর মনে বিন্দুমাত্রও আসক্তি থাকে না।১৮আমার প্রিয় ভক্ত স্বল্পভাষী ও মৌনী। স্তুতি নিন্দায় তাঁর সমজ্ঞান। তিনি অল্পে তুষ্ট।১৯যে-সকল শ্রদ্ধাযুক্ত ভক্ত এই ধর্মামৃত পান করেন তাঁরা আমার অতি প্রিয়।২০. * দ্বাদশ অধ্যায় সমাপ্ত * ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযোগ অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় কাকে বলে তা বুঝিয়ে বল।১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, এ দেহকে ক্ষেত্র বলে। যিনি ক্ষেত্রকে জানেন তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ।২মনে রেখ- আমিই ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ। ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের জানাই জ্ঞান।৩ক্ষেত্রের স্বরূপ এবং ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভাব তোমাকে বলছি শোন।৪পণ্ডিতগণ ক্ষেত্রতত্ত্ব নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বেদান্তে আবার ভিন্নভাবে এর বর্ণনা করা হয়েছে।৫পঞ্চ মহাভূত, দশ ইন্দ্রিয়, রূপরসাদি, পঞ্চ বিষয় ও ইচ্ছাদ্বেষাদি- এরাই সংক্ষেপে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ বিকার।৬-৭হে অর্জুন, অমানিতা, সহিষ্ণুতা, শুদ্ধি, সরলতা, অহিংসা, গুরুসেবা, স্থিরতা, বিষয়ে বৈরাগ্য, অহংকার, শূন্যতা জন্ম-মৃত্যু, জরা-ব্যাধি ও দুঃখে দোষ ধরা, সংসারে অনাসক্তি, নিঃস্পৃহতা, শুভ-অশুভ সমজ্ঞান, মনের একনিষ্ঠা,নির্জনে বাস, সঙ্গ পরিত্যাগ, আমার প্রতি ভক্তি, কর্তৃত্ত্বাভিমান ত্যাগ, মোক্ষ সম্বন্ধে এরা জ্ঞান।৮১২যা হতে অমৃতত্ত্ব, যিনি জ্ঞেয়, তিনি পরম ব্রহ্ম, অনাদি এবং নিত্য সনাতন।১৩তাঁর হস্ত পদ কর্ণ সর্বব্যাপী। সর্বত্র তাঁর নয়ন। তিনি সর্বব্যাপী।১৪তিনি নিঃসঙ্গ অথচ আধার স্বরূপ। তিনি সগুণ অথচ নির্গুণ।১৫তিনি চরাচর বিশ্ব ব্যাপিয়া আছেন। তিনি সূক্ষ ও অধিজ্ঞেয়। তিনি বিষয়ে থেকেও দূরে আছেন।১৬তিনি সর্বভূতে অবিভক্ত থেকেও ভিন্ন। তিনি বিশ্বের সৃষ্টকর্তা ও সংহার কর্তা।১৭ব্রহ্ম অন্ধকারের ঊর্ধ্বে। তিনি জ্যোতিষ্কের জ্যোতি। জ্ঞানের দ্বারাই তাঁকে জানতে হয়। তিনি সকলের হৃদয়েই বিদ্যমান আছেন।১৮ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয় সম্বন্ধে তোমাকে বললাম। এটি জেনে ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হয়।১৯প্রকৃতিকে ও পুরুষকে অনাদি বলে জানবে। এই তিন জানতে পারলে ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হয়। বিকারাদি প্রকৃতি গুণ।২০প্রকৃতি কার্য-কারণের কারণ। আর সুখ-দুঃখ ভোগের কারণ পুরুষ।২১পুরুষ প্রকৃতির গুণ ভোগ করেন এবং সেই গুণের প্রভাবে ভালো বা মন্দ জন্ম লাভ করে।২২পরমেশ্বর স্রষ্টা, কর্তা ও ভোক্তা। তিনি পরমাত্মারূপে সকলের শরীরে বিরাজমান আছেন।২৩যে ব্যক্তি প্রকৃতি ও পুরুষকে জানতে পারে, তার জন্ম হয় না।২৪কর্মযোগে, জ্ঞানে, ধ্যানে, বুদ্ধিতে কিংবা শুদ্ধচিত্তে আত্মাকে দর্শন করা যায়।২৫অজ্ঞান ব্যক্তি অন্যের মুখে শুনেও যদি পরমেশ্বরের উপাসনা করে তথাপি শ্রদ্ধার বলে সে মৃত্যুভয় হতে রক্ষা পায়।২৬হে অর্জুন, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যোগে স্থাবর জঙ্গমাদি জন্মে থাকে।২৭পরমেশ্বর সর্বভূতে বিরাজ করছেন। নিত্য ও নশ্বরকে যে সমানভাবে দেখে সে-ই প্রকৃতপক্ষে দেখে।২৮পরমেশ্বর সর্বত্র সমান- এই জ্ঞান যাঁর আছে তিনি আত্মহিংসা হতে মুক্ত হয়ে উত্তম গতি প্রাপ্ত হন।২৯প্রকৃতিই সমস্ত কাজ করিয়ে থাকেন- জানতে পারলে অকর্তা আত্মাকে দেখা যায়।৩০আত্মা এক, কিন্তু তাঁর ভূতভাব ভিন্ন। এটি জানলে ব্রহ্মলাভ হয়ে থাকে।৩১হে অর্জুন, আত্মা অনাদি, অনন্ত ও অব্যয়। দেহে তিনি কর্তানন, সেখানে তিনি নিষ্ক্রিয় ও নির্লিপ্ত।৩২সূর্য যেমন আকাশে থেকেও আকাশে লিপ্ত থাকে না, আত্মাও সেইরূপ দেহে থাকলেও দেহে লিপ্ত থাকে না।৩৩এক সূর্য যেমন সমস্ত জগতকে আলোকিত করে, এক আত্মাও সেইরূপ সকলের দেহকে প্রকাশিত করেন।৩৪জ্ঞানের বলে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের ভেদ এবং জীবের প্রকৃতি জানতে পারলে মোক্ষ লাভ হয়ে থাকে।৩৫. * ত্রয়োদশ অধ্যায় সমাপ্ত * চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয় বিভাগযোগ শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, যে-সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান জেনেমুনি-ঋষিগণ মোক্ষলাভ করেন তা আমি তোমাকে এখন বলব।১এই জ্ঞানের বলে জ্ঞানী ব্যক্তি পুনর্জন্ম গ্রহণ করে না। প্রলয়কালেও দুঃখ ভোগ করেনা।২মহত্ ব্রহ্ম আমার গর্ভাধান স্থান। ব্রহ্মাদি সকল প্রাণী- তাতে জন্ম লাভ করে।৩হে অর্জুন, মহত্ ব্রহ্ম সকল সৃষ্টির মাতা। আর আমি তাদের পিতা।৪প্রকৃতির তিনটি গুণ- সত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ। এই তিন গুণ অব্যয় দেহীকে বদ্ধ করে।৫হে অর্জুন, এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ অতি পবিত্র। এই গুণের বলে আত্মা বেশ ভালোভাবেই দেহে অবস্থান করেন।৬কামনা-বাসনা হতে রজোগুণ জন্মে। এই গুণ মানুষকে কাজে প্রবৃত্ত ক’রে বদ্ধ করে।৭অজ্ঞানতা হতে তমোগুণের উত্পত্তি। এই গুণের প্রভাবে মোহঘটে থাকে।৮সত্ত্বগুণে সুখ লাভ হয়। রজোগুণে কাজে আসক্তি বাড়ে। তমোগুণে বুদ্ধিনাশ হয় ও প্রমাদ ঘটে।৯এই গুণের মধ্যে কারো সত্ত্বগুণ প্রধান হয়, কারো রজোগুণ প্রধান হয়, কারো তমোগুণ প্রধান হয়।১০সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পেলে নির্মল জ্ঞান উত্পন্ন হয়।১১রজোগুণ বৃদ্ধি পেলে লোভ, ক্ষোভ, স্পৃহা প্রভৃতি জন্মে থাকে।১২তমোগুণ বৃদ্ধি পেলে বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান লোপ পায়।১৩যে-সময় সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়, সেই সময় যাদের মৃত্যু হয়; তারা দিব্যলোক লাভ করে।১৪রজো বৃদ্ধিকালে মরলে নরলোকে যায় এবং তমো বৃদ্ধিকালে মরলে পশুযোনি প্রাপ্ত হয়।১৫সত্ত্বগুণের ফলে সুখ, রজোগুণের ফলে দুঃখ এবং তমোগুণের ফলে অজ্ঞানতা প্রাপ্ত হয়।১৬সত্ত্বগুণে জ্ঞান লাভ, রজোগুণে লোভ এবং তমোগুণে মোহ প্রভৃতি জন্মে।১৭সত্ত্বগুণের ফলে স্বর্গলোক প্রাপ্ত হয়, রজোগুণের ফলে নরলোক প্রাপ্ত হয় এবং তমোগুণের ফলে অধঃপতন ঘটে।১৮প্রকৃতির এই তিনটি গুণই কাজ করায়। আত্মা এই তিন গুণের অতীত। আত্মা আমার ভাবেই থাকে।১৯এই তিনটি গুণ দেহ হতে জাত। এদেরকে অতিক্রম করতে পারলেই জন্ম-মৃত্যু, জরা-দুঃখ হতে মুক্তি লাভ ক’রে মোক্ষ লাভ করে।২০অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, যেভাবে ত্রিগুণের অতীত হওয়া যায় তা আমাকে বল।২১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, জ্ঞান, মোহ বা কামনাবশতঃ ইচ্ছা-দ্বেষ মুক্ত হলেই গুণাতীত হওয়া যায়।২২যে ব্যক্তি ধীর-স্থিরভাবে নিজের কার্য করে যান, তিনি গুণের মধ্যে থেকেও গুণের অতীত।২৩স্বর্ণ-লোষ্ট্রে, সুখ-দুঃখে বা নিন্দা-স্তুতিতে ধীর ব্যক্তি সমজ্ঞান হয়।২৪মান-অপমানে, শত্রু-মিত্রে যাঁর সমজ্ঞান এবং যিনি উদ্যম-ত্যাগী, তিনিই গুণাতীত।২৫হে অর্জুন- যে ব্যক্তি ভক্তির সাথে আমার ভজনা করে, সেই ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করে থাকেন।২৬ব্রহ্ম আমাতেই অবস্থিত। মুক্তির আশ্রয়ও আমি। আমার সেবাকরলেই মুক্তি লাভ হয়।২৭. * চতুর্দশ অধ্যায় সমাপ্ত * পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষোত্তমযোগ শ্রীকৃষ্ণ বললেন- পণ্ডিতগণ বলেন- এই সংসার একটি অশ্বত্থবৃক্ষ। এর মূল উপরের দিকে এবং ডালগুলি নিচের দিকে। বেদমন্ত্র-সকল এর পত্রস্বরূপ। সংসাররূপ অশ্বত্থ বৃক্ষকে যিনি জানেন তিনিই বেদজ্ঞ।১সেই অশ্বত্থ বৃক্ষের শাখাগুলি উপরের দিকে কিংবা নিচের দিকে যায়। আরও নিচে মনুষ্যলোকে এর মূল গিয়েছে।২জীবগণ এই বৃক্ষের আদি, অন্ত ও মধ্য বুঝতে পারে না। বৈরাগ্যের দ্বারা এই বৃক্ষের মূল ছেদন করা যায়।৩আদি পুরুষের শরণ নিয়ে সেই পরম পদ খুঁজতে হবে।৪মোহ-মান, কামনা-বাসনামুক্ত ও সুখ-দুঃখমুক্ত জ্ঞানী ব্যক্তি ব্রহ্মপদ লাভ করে থাকে।৫চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি যাকে প্রকাশ করতে পারে না; আমার পরম ধাম খোঁজ পেলে তার পুনর্জন্ম হয় না।৬আত্মা আমার অংশ। কিন্তু পরম পদ লাভ না করা পর্যন্ত আত্মা বারবার পুনর্জন্ম গ্রহণ করে থাকেন।৭আত্মা পুরাতন দেহ ছেড়ে ইন্দ্রিয় ও মনকে নিয়ে আবার নতুন শরীরকে আশ্রয় করে।৮আত্মা দেহে থেকে জিহবা, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গণের সাহায্যে বিষয় ভোগ করে।৯অজ্ঞান ব্যক্তি ভোগে মত্ত থাকে। তাই সে আত্মাকে জানতে পারে না। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি আত্মার অবস্থা বুঝতে পারেন।১০অবিবেকী ভোগী ব্যক্তি আত্মাকে বুঝতে পারে না। কিন্তু যোগী ব্যক্তি এই শরীরেই তাঁকে দেখতে পারেন।১১চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি জগতকে প্রকাশিত করে। কিন্তু তারাও আমার নিকট হতে তেজ পেয়ে থাকে।১২আমি নিজের বলে সকলকে ধারণ করি। আমিই চন্দ্র হয়ে শস্য পরিপুষ্ট করে থাকি।১৩আমি জঠরাগ্নিরূপে প্রাণীদের শরীরে থেকে চার প্রকার অন্ন পরিপাক করে থাকি।১৪আমি সকলের হৃদয়ে অধিষ্ঠান করি। আমা হতে স্মৃতি, বিস্মৃতি ও জ্ঞান জন্মে। বেদের জ্ঞাতব্য বিষয় ও বেদান্তের কর্তা আমি।১৫পুরুষ দুই প্রকার- ক্ষর ও অক্ষর। সর্বজীবে ক্ষর পুরুষ ও কুটস্থ-পুরুষ অক্ষর পুরুষ।১৬পরমাত্মা নামে একজন উত্তম পুরুষ আছেন। তিনি অব্যয় ও নিত্য। তিনি ত্রিলোক পালন করেন।১৭উত্তম পুরুষ ক্ষর পুরুষের অতীত এবং অক্ষর পুরুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আমিই সেই উত্তম পুরুষ। আমি পুরুষোত্তম।১৮জ্ঞানী ব্যক্তিগণ আমাকে পুরুষোত্তম বলেই জানেন। জেনে তাঁরা সর্বদাই আমার ভজনা করেন।১৯হে অর্জুন- এই গোপনীয় বিদ্যা তোমাকে বললাম, এটি জানলে জ্ঞানী ও কৃতার্থ হওয়া যায়।২০. * পঞ্চদশ অধ্যায় সমাপ্ত * ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর-সম্পদ বিভাগযোগ শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ভয়শূন্যতা, সরলতা, সন্তোষ, তপস্যা, যজ্ঞ, দান, দম, আক্রোধ, লোভশূন্যতা, লজ্জা, সত্য, ত্যাগ, শান্তি, স্থিরতা, শাস্ত্রপাঠ, নম্রতা, ক্ষমতা, ধৈর্য, তেজ, শুদ্ধি, অবিরোধ, অমানিতা এই সকল দৈবতা।১-৩অভিমান, অজ্ঞানতা, নিষ্ঠুরতা, দম্ভ, দর্প, ক্রোধ এইসব আসুর ভাব।৪দৈব ভাবে মোক্ষলাভ হয় আর আসুর ভাবে বন্ধন ঘটে। হে অর্জুন, তুমি শ্রেষ্ঠ বংশজাত।তোমার দুঃখ কেন?৫জীবের দুইটি ভাব- দৈব ও আসুর। দৈব ভাবের কথা বলেছি। আসুরভাবের কথা বলছি, শোন।৬আসুর প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জানে না; তার সদাচার, সত্য ও শুদ্ধি কিছুই নেই।৭অসুরেরা সত্য, ধর্ম ও ঈশ্বর মানে না। ভোগ বাসনার পরিতৃপ্তিই তাদের সব।৮হে অর্জুন, অল্পবুদ্ধি মানব হীন দৃষ্টি ও মতিহীন হয়ে থাকে। ধ্বংসের জন্যই তারা পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে থাকে।৯তারা কাম, মদ, মান, দম্ভ ও শুচিহীন হয়ে দুরাগ্রহে ধাবিত হয়।১০যারা মূঢ় তারা আমরণ কাম চিন্তা করে। তারা কামভোগ ছাড়া আর কিছুই জানে না।১১সেই মূর্খ ব্যক্তিরা শত আশা-পাশে বদ্ধ থাকে। তারা ভোগেরজন্যই অর্থ উপার্জন করে।১২তারা ভাবে- “আজ আমার এই আছে, পরে আমার আরও ধন হবে।”১৩তারা ভাবে- “আমার এই শত্রু হত হয়েছে অপর শত্রুও নষ্ট হবে। আমি সিদ্ধ, বলবান, ভোগী ও সুখী। আমিই ঈশ্বর।১৪তারা অজ্ঞানতাবশতঃ মনেকরে- “এই পৃথিবীতে আমি কুলীন ও ধনবান। দানে ও যজ্ঞে আমার সমান কেউ নেই।”১৫ভ্রান্তচিত্ত ব্যক্তিগণ মোহজালে সমাবৃত। সর্বদা কাম-ভোগরত থাকে বলে তারা নরকে পতিত হয়।১৬যে ব্যক্তি ধন, মান ও মদগর্বে গর্বিত সে বিধি ত্যাগ করে যশের জন্য যজ্ঞ করে।১৭ঈদৃশ ব্যক্তি অহংকার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধ-বশে পর বোধে আমাতেই ঘৃণা করে।১৮ঈদৃশ ব্যক্তি ধর্মদ্বেষী, ক্রুরমতি ও অধম। বারবার তার আসুরী যোনিতে জন্ম গ্রহণ করতে হয়।১৯ঈদৃশ মূর্খ ব্যক্তি আসুরী যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে আমাকে পায় না, আরো অধোপতি লাভ হয়।২০কাম, ক্রোধ ও লোভ- এই তিনটি নরকের দ্বার, এরা আত্মবিনাশক। এদেরকে ত্যাগ কর।২১হে অর্জুন, যে ব্যক্তি এই তিনটি দ্বার হতে মুক্ত, সেই ব্যক্তি আত্মার উন্নতি সাধন করতঃ উত্তম গতি লাভ করেন।২২যে ব্যক্তি শাস্ত্রের বিধি ত্যাগ করে স্বেচ্ছাচারণ করেসে সিদ্ধি-সুখ ও পরাগতি লাভ করে পারে না।২৩শাস্ত্রীয় প্রমাণের দ্বারাই কর্ম ও অকর্ম নির্ণয় করতে হয়। হে অর্জুন, শাস্ত্রের বিধি জেনে তুমি কর্ম কর।২৪. *ষোড়শ অধ্যায় সমাপ্ত * সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগযোগ অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, যারা শাস্ত্রের বিধান মেনে চলে না অথচ শ্রদ্ধার সাথে ভজনা করে তাদের শ্রদ্ধা কীরূপ?১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, শ্রদ্ধা তিন প্রকার- সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। এরা স্বভাবজাত।২যার যেমন মনের ভাব তার তেমন শ্রদ্ধা হয়ে থাকে।৩সাত্ত্বিক শ্রদ্ধার লোকে দেবতার, রাজসিক শ্রদ্ধার লোকেযক্ষরাক্ষসাদির এবং তামসিক গুণের লোকে ভূত-প্রেতের পূজা করে।৪যারা অহংকারবশে শাস্ত্রের বিধান না মেনে কঠোর তপস্যা ক’রে আসক্তিপরায়ণ এবং বলশালী হয়ে শরীরস্থ ভূতসমূহকে কষ্ট দেয় এবং শরীরস্থ আমাকেও ক্লেশ প্রদান করে তারা আসূর প্রকৃতি বলে জানবে। তারা শরীরের মধ্যস্থিত আত্মারূপী আমাকে দেখতে পায় না।৫-৬প্রকৃতি-ভেদে সকলেরই আহার তিন প্রকার- যজ্ঞ, দান এবং তপস্যা। তপস্যাও তিন প্রকার।৭সাত্ত্বিক আহার নরম, স্নিগ্ধ ও প্রীতিকর। এতে স্বাস্থের উন্নতি হয়।৮রাজসিক আহার অতি তিতা, অতি টক, অতি নোন্তা ইত্যাদি। তাতেদুঃখ, রোগ ও শোক জন্মে।৯দুর্গন্ধযুক্ত, বাসি, এঁটো অপবিত্র- এইসব তামসিক আহার।১০যিনি ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে যজ্ঞ ও দান করে থাকেন তিনি সাত্ত্বিক, শ্রেষ্ঠ।১১হে অর্জুন, যে ব্যক্তি ফলের আকাঙ্ক্ষা ক’রে কাজ করে সেই কর্মকে রাজসিক কর্ম বলে জানবে।১২শ্রদ্ধাশূন্য, বিধিহীন এবং দক্ষিণাবিহীন যে যজ্ঞ দানাদি তাতে তামসিক বলে জানবে।১৩দেবতা, ব্রাহ্মণ, গুরু ও জ্ঞানী লোকের পূজা, শরীর ও মনের পবিত্রতা, সরলতা, ব্রহ্মচর্য, অহিংসা- এইগুলো শারীরিক তপস্যা।১৪সত্য, প্রিয় ও হিতকর বাক্য এবং বেদপাঠ- এইসব বাচনিক তপস্যা।১৫চিত্তের প্রসন্নতা, বাকসংযম, মনঃসংযম ও অকপটতা- এইসব মানসিক তপস্যা।১৬ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ ক’রে যিনি কায়িক, বাচনিক ও মানসিক তপস্যা করেন তাঁর তপস্যা সাত্ত্বিক তপস্যা।১৭যে ব্যক্তি লোকের প্রশংসা পাওয়ার জন্য অহংকারের সাথে তপস্যা করে তার তপস্যা রাজসিক তপস্যা।১৮যে ব্যক্তি নিজের শরীরকে কষ্ট দেয়ার জন্য বা অন্যের সর্বনাশ করার জন্য কষ্ট দেয় তার সেই তপস্যা তামসিক তপস্যা।১৯“দান করা কর্তব্য”- এই ভেবে দেশ, কাল ও পাত্র হিসাবে অনুপকারী ব্যক্তিকে যে দান করা হয় তা সাত্ত্বিক দান।২০প্রতিদিন বা স্বর্গলাভের আশায় যে দান করা হয় তা তামসিক দান।২১অস্থানে, অসময়ে বা অপাত্রে যে দান বা তাচ্ছিল্যের সাথে যে দান তা তামসিক দান।২২“ওঁ তত্সত্”- এটি ব্রহ্মের নাম। এই নাম হতেই ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞের সৃষ্টি হয়।২৩সেই জন্যই ব্রহ্মবাদিগণ “ওঁ” উচ্চারণ ক’রে শাস্ত্রীয় কার্য করেন।২৪মুক্তিকামী ব্যক্তিগণ ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে “তত্” উচ্চারণ করে কার্য করেন।২৫কর্মিগণ “আছে” অর্থ ও “উত্তম” অর্থ বুঝাতে এবং মঙ্গল কার্য্যে “সত্” শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।২৬যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে যে নিষ্ঠা তা “সত্” নামে অভিহিত হয় এবং ভগবত্ প্রীতির জন্য যেসকল কাজ তাও “সত্” বলে কথিত হয়।২৭অশ্রদ্ধার সাথে যজ্ঞ দান বা যা-কিছু করা হয় তা কখনো “সত্” নয়। ইহলোক ও পরলোকে তাতে কোন শুভ ফলই হয় না।২৮. * সপ্তদশ অধ্যায় সমাপ্ত * অষ্টাদশ অধ্যায়ঃ মোক্ষযোগ (পৃষ্ঠা-১) হে কৃষ্ণ, ‘সন্ন্যাস’ ও ‘ত্যাগ’ বলতে কী বুঝায় তা আমাকে বল।১শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, কাম্য-কর্ম ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে। আর সর্ব কর্মফল ত্যাগকে ত্যাগ বলে।২কেউ কেউ বলেন- কাম্য মাত্রই দোষের, অতএব তা পরিত্যাজ্য। আবার কেউ কেউ বলেন- কাম্যকর্ম ত্যাজ্য নয়।৩হে অর্জুন, তোমাকে ত্যাগ সম্বন্ধে বলছি। ত্যাগ তিন প্রকার।৪যজ্ঞ, দান ও তপস্যা প্রভৃতি কর্ম কখনও পরিত্যাজ্য নয়। কারণ, এদের দ্বারা চিত্তশুদ্ধ হয়ে থাকে।৫হে অর্জুন, ফলের আশা ছেড়ে এই সকল কর্ম করবে- এটিই আমার মত।৬নিয়ত কর্ম কখনো পরিত্যাগ করতে নেই। অজ্ঞানতাবশতঃ ত্যাগকরলে তা তামসিক ত্যাগ হয়।৭যে ব্যক্তি দুঃখের ভয়ে কর্ম ত্যাগ করে তার ত্যাগকে রাজসিক ত্যাগ বলে।৮ফলের আশা ছেড়ে যে-কর্তব্য কর্ম করা হয় তাকে সাত্ত্বিক ত্যাগ বলে।৯সাত্ত্বিক ত্যাগী ব্যক্তি দুঃখকর কাজে দুঃখবোধ করেন না, সুখকর কাজেও আনন্দ পান না।১০মানুষ কাজ একেবারে ত্যাগ করতে পারে না, কিন্তু কর্মের ফল ত্যাগ করতে পারে। যিনি কর্মের ফল ত্যাগ করতে পারেন তিনিই ত্যাগী।১১ভাল-মন্দ মিশ্রকর্মেরই এই রকম ফল। ফলত্যাগী সন্ন্যাসিগণ কর্মফল ভোগ করেন না।১২বেদান্তমতে কর্মসম্পাদনের পাঁচটি কারণ। তা বলছি, শোন।১৩অধিষ্ঠান, কর্তা, বিবিধ কারণ, কর্তার বিবিধ কার্য ও দৈব এই পাঁচটি কর্মসম্পাদনের কারণ।১৪মানুষ ভালোমন্দ যা কিছু করে তা এই পাঁচটি কারণ হতেই হয়ে থাকে।১৫অল্পবুদ্ধি ব্যক্তি তা বুঝতে পারে না। সে আত্মাকেই কর্তা বলে মনে করে।১৬যে কর্ম করে কিন্তু ফলের আশা করে না, সে জগতকে বধ করলেও পাপের ভোগী হয় না।১৭সাংখ্যমতে কারণ তিনটি- জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা।১৮জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা এই তিনটি কারণ গুণভেদে হয়। বলছি, শোন।১৯প্রাণীগণ ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আত্মা এক। এই জ্ঞান সাত্ত্বিক জ্ঞান।২০যে মনে করে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন আত্মা বিরাজ করেন, তার জ্ঞান রাজসিক জ্ঞান।২১এই জ্ঞান প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝে এই সমস্ত বুদ্ধি কোন একটি বিষয়ে আসক্ত থাকে সেই যুক্তিবিরোধী অযথার্থ এবং তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে।২২যিনি আসক্তি ও ফলাকাঙ্ক্ষাহীন এবং যিনি কর্তব্য মনে করেই কাজ করেন তাঁর কাজই সাত্ত্বিক কাজ।২৩যে ব্যক্তি আসক্তিবশতঃ ফলের আশায় কিংবা কষ্টের সাথে কাজ করে তার কাজ রাজসিক কাজ।২৪যে ব্যক্তি পরিণাম, ক্ষয়, হিংসা কিংবা নিজের পৌরুষ না ভেবে কাজ করে তার কাজ তামসিক কাজ।২৫যে ব্যক্তি ফলাফলে নির্বিকার, যার অহংকার নেই, সে সাত্ত্বিক কর্তা।২৬যে ব্যক্তি আসক্ত, লোভী, লাভে আনন্দিত ও অলাভে দুঃখিত হয়, সে রাজসিক কর্তা।২৭যে ব্যক্তি অভদ্র, অলস, শঠ ও দীর্ঘসূত্রী সে তামসিক কর্তা।২৮সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ- এই তিনগুণ অনুসারে বুদ্ধি ও ধৃতি তিন প্রকার। এখন তোমাকে তা বলছি।২৯যে বুদ্ধি দ্বারা প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি, কর্তব্য-অকর্তব্য, ভয়-অভয়, মুক্তি ও বন্ধন নির্ণয় করা যায় তা সাত্ত্বিক বুদ্ধি।৩০যে বুদ্ধি দ্বারা ধর্ম-অধর্ম কর্তব্য-অকর্তব্য প্রভৃতিবুঝা যায় না তা রাজসিক বুদ্ধি।৩১তামসিক বুদ্ধির বলে মানুষ অধর্মকেই ধর্ম বলে মনে করে।৩২এখন ধৃতির কথা বলছি। সাত্ত্বিক ধৃতির বলে মানুষ মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়কে সহজে দমন করতে পারে।৩৩যার রাজসিক ধৃতি তার বাসনা প্রবল হয়। সেই ব্যক্তি ধর্ম, অর্থ-কাম-মোক্ষ অপেক্ষাও বাসনাকে বড় মনে করে।৩৪তামসিক ধৃতির বলে মানুষ নিদ্রা, ভয় ও শোক-দুঃখে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।৩৫হে অর্জুন, সুখও ত্রিবিধ- সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। সে সম্বন্ধে তোমাকে বলছি।৩৬সাত্ত্বিক সুখে আনন্দ জাগে, সমস্ত দুঃখ দূরে যায় এবং পরিণাম সুখের হয়।৩৭রাজসিক সুখ ইন্দ্রিয় হতে জন্মে। এটি প্রথমে খুবই আনন্দের, কিন্তু পরিণামে দুঃখময়।৩৮নিদ্রা, আলস্য ও প্রমাদ হতে যে সুখ জন্মে তা তামসিক সুখ।এটি সর্বদাই মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।৩৯দেবতা, মানব বা অন্য কোনো প্রাণীই স্বভাব কাটিয়ে উঠতে পারে না।৪০স্বভাবের গুণেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র- এই চার জাতির বিভক্ত হয়েছে।৪১শম, দম, ক্ষমা, তপস্যা, শৌচ, আস্তিকা, শুচিতা, জ্ঞান, সরলতা- এইসব ব্রাহ্মণের কর্ম।৪২শৌর্য, বীর্য, পরাক্রম, যুদ্ধ, শাসন, প্রভুত্ব- এইসব ক্ষত্রিয়ের কর্ম।৪৩কৃষি, গোপালন ও বাণিজ্য বৈশ্যের কর্ম। আর সেবা হচ্ছে শূদ্রের কর্ম।৪৪মানুষ নিজ নিজ কর্মে রত থেকে সিদ্ধি লাভ করে। এ সম্বন্ধে তোমাকে বলছি।৪৫হে অর্জুন, মানুষ স্বধর্ম পালন ক’রে যিনি সর্বভূতে অধিষ্ঠিত সেই বিশ্বময়ের পূজা করে থাকেন।৪৬স্বধর্ম দোষযুক্ত হলেও পরধর্ম হতে বড়। যে স্বধর্ম পালন করে তার কোনো পাপ হয় না।৪৭ অষ্টাদশ অধ্যায়ঃ মোক্ষযোগ (পৃষ্ঠা-২) স্বধর্ম দোষযুক্ত হলেও তা কখনও পরিত্যাগ করার নয়। অগ্নিতে যেমন ধুম থাকে স্বধর্মেও তেমন কিছুটা দোষ থাকবেই।৪৮যে সংযত ব্যক্তি অনাসক্ত হয়ে কর্ম করে সে কর্মের বন্ধন হতে মুক্ত হয়।৪৯হে অর্জুন, সিদ্ধিলাভ করলে কীভাবে ব্রহ্মভাব হয় তা তোমাকে বলব।৫০বুদ্ধি দ্বারা মনকে নির্মল ও সংযত করবে। তবেই ভোগের বিষয়-সকল দূর হয়ে যাবে।৫১নিরিবিলি থাকলে ও নিরামিষ খেলে মন সংযত হয়।৫২অহংকার, বল, কাম, ক্রোধ, লোভ ত্যাগ করতে পারলে মন নির্মল হয়।৫৩ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হলে মন সুপ্রসন্ন হয়। তখন সর্বভূতে সমদৃষ্টি হয় এবং আমার প্রতি ভক্তি লাভ করে।৫৪আমি সর্বব্যাপী। ভক্তিভরে আমার স্বরূপ জেনে আমার ভক্ত আমাতেই প্রবেশ করে।৫৫আমার ভক্ত সমস্ত কর্ম করেও আমার অনুগ্রহে অব্যয় পদ প্রাপ্ত হয়।৫৬হে অর্জুন, তুমিও সমস্ত কর্মের ফল আমাতে সমর্পণ ক’রে এবংআমাতে মনপ্রাণ রেখে স্বকর্ম করতে থাক।৫৭মদগত চিত্ত হয়ে আমার উপদেশ অনুসারে চললেই তোমার মঙ্গল হবে।৫৮অহংকারবশতঃ যদিও তুমি বল “আমি যুদ্ধ করব না” এটা ভুল। প্রকৃতিই তোমাকে কাজ করাবে।৫৯যুদ্ধ তোমার স্বাভাবিক কর্তব্য। তুমি যদি স্বেচ্ছায় যুদ্ধ না কর তবে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির প্রভাবে তুমি যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে।৬০ঈশ্বর সকল প্রাণীর মধ্যে আছেন। তিনিই তাদেরকে যন্ত্রারূঢ় পুতুলের মত ঘোরাচ্ছেন।৬১হে অর্জুন, তুমি সর্বভাবে তাঁরই শরণ লও। তাঁর অনুগ্রহেইতুমি শান্তি ও নিত্য স্থান লাভ করবে।৬২অতিগুহ্য এই কথা তোমাকে বললাম। এটা শুনে যা সঙ্গত মনে কর তাই কর।৬৩তোমার ভালোর জন্য সর্বাপেক্ষা গুহ্য কথাটি তোমাকে এখন বলব।৬৪আমাতে মন নিবিষ্ট কর, আমার ভক্ত হও, আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমাকেই পাবে কেননা তুমিই আমার অতি প্রিয়।৬৫সমস্ত ধর্ম-কর্ম বাদ দিয়ে তুমি আমারই শরণ লও। আমি তোমাকে সকল পাপ হতে মুক্ত করব।৬৬যে ভক্তিহীন, স্বধর্মে যার নিষ্ঠা নেই এবং যে আমার নিন্দা করে, সেই সব ব্যক্তিকে গীতাশাস্ত্র বলবে না।৬৭যে ব্যক্তি ভক্তির সাথে গীতাশাস্ত্র ভক্তজনদেরকে পাঠ করে শোনায় সে অন্তিমে আমাকেই পেয়ে থাকে।৬৮মানুষের মধ্যে তার চেয়ে প্রিয় আমার আর কেউ নাই।৬৯যিনি গীতা পাঠ করবেন তিনি জ্ঞানরূপ যজ্ঞদ্বারা আমারই পূজা করবেন- এটাই আমি মনে করি।৭০যে ব্যক্তি ভক্তির সাথে গীতাশাস্ত্র শ্রবণ করেন তিনি পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যলোক প্রাপ্ত হন।৭১হে অর্জুন, তুমি মন দিয়ে আমার কথা শুনেছ তো? তোমার মোহ দূর হয়েছে তো?৭২অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তোমার অনুগ্রহে আমার মোহ দূর হয়েছে। আমার মন স্থির। আমার মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নাই।৭৩হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই কথোপকথন আমি শুনেছি।৭৪মহর্ষি ব্যাসের অনুগ্রহে আমিই এই গীতা শ্রীকৃষ্ণকে বলতে ও অর্জুনকে শুনতে শুনেছি।৭৫এই পুণ্যকথা আমি বার বার স্মরণ করছি আর বার বার আমার আনন্দ হচ্ছে।৭৬বিশ্বরূপের দৃশ্যটি যতই আমার মনে পড়ছে ততই শরীর পুলকিত হচ্ছে।৭৭যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ও বীর অর্জুন বিরাজমান সেখেনেই জয় ও রাছলক্ষ্মী বিরাজ করবেন- এটিই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।৭৮. *অষ্টাদশ অধ্যায় সমাপ্ত * গীতা-সারকথা গীতার প্রথম কথা নিষ্কাম কর্ম। অর্থাত্ ফলের আকাঙ্ক্ষানা করে কর্ম করা। নিষ্কাম কর্ম করতে করতে জ্ঞানের উদয় হয়। জ্ঞানবলে কর্মী বুঝতে পারেন যে, ভগবান সকল কারণের কারণ এবং সমস্ত কাজ ভগবানের।জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে জাগে ভক্তি। ভক্ত মন-প্রাণ ভগবানে সমর্পণ করে মোক্ষলাভ করে থাকেন।~* শুভম *~